Sunday, February 11, 2018

আত্মজ্ঞান

১। মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান্ দেখা দেন।

২। দুই রকম 'আমি' আছে - একটা পাকা 'আমি' আর একটা কাঁচা। আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার ছেলে - এগুলো কাঁচা 'আমি'; আর পাকা 'আমি' হচ্ছে - আমি তাঁর দাস, আমি তাঁর সন্তান, আর আমি সেই নিত্য-মুক্ত-জ্ঞানস্বরূপ।

৩। এক ব্যক্তি তাঁকে বলেছিলেন, "আমার এক কথায় জ্ঞান হয়, এমত উপদেশ দিন।" তিনি বললেন, "'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' - এইটি ধারণা কর।" ইহা বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

৪। শরীর থাকতে আমার 'আমিত্ব' একেবারে যায় না, একটু-না-একটু থাকেই; যেমন নারিকেল গাছের বালতো খসে যায়, কিন্তু দাগ থাকে। কিন্তু এই সামান্য 'আমিত্ব' মুক্ত পুরুষকে আবদ্ধ করতে পারে না।

৫। নেংটা তোতাপুরীকে পরমহংসদেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "তোমার যে অবস্থা তাতে রোজ ধ্যান করার আবশ্যক কি?" তোতাপুরী উত্তরে বলেছিলেন, "ঘটি যদি রোজ রোজ না মাজা যায়, তা হলে কলঙ্ক পড়ে। নিত্য ধ্যান না করলে চিত্ত অশুদ্ধ হয়।" পরমহংসদেব উত্তরে বল্লেন, "যদি সোনার ঘটি হয়, তা হলে পড়ে না।" অর্থাৎ সচ্চিদানন্দ লাভ করলে আর সাধনের দরকার নেই।

৬। বিচার দুই প্রকার জানবে - অনুলোম ও বিলোম। যেমন খোলেরই মাঝ ও মাঝেরই খোল।

৭। 'আমি'-বোধ থাকলে 'তুমি'-বোধও থাকবে। যেমন যার আলো জ্ঞান আছে, তার অন্ধকার জ্ঞানও আছে; যার পাপ জ্ঞান আছে, তার পুণ্য জ্ঞানও আছে; যার ভাল বোধ আছে, তার মন্দ বোধও আছে।

৮। যেমন পায়ে জুতা পরা থাকলে লোকে স্বচ্ছন্দে কাঁটার ওপর দিয়ে চলে যায়, তেমনি তত্ত্বজ্ঞানরূপ আবরণ পরে মন এই কণ্টকময় সংসারে বিচরণ করতে পারে।

৯। একজন সাধু সর্বদা জ্ঞানোন্মাদ-অবস্থায় থাকতেন, কারও সহিত বাক্যালাপ করতেন না, লোকেরা তাঁকে পাগল বলে জানত। একদিন লোকালয়ে এসে ভিক্ষা করে এনে একটা কুকুরের উপর বসে সেই ভিক্ষান্ন নিজে খেতে লাগলেন ও কুকুরকে খাওয়াতে লাগলেন। তাই দেখে অনেক লোক সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে পাগল বলে উপহাস করতে লাগল। এই দেখে সেই সাধু লোকদিগকে বলতে লাগলেন, "তোমরা হাসছ কেন?

বিষ্ণূপরি স্থিতো বিষ্ণুঃ
বিষ্ণুঃ খাদতি বিষ্ণবে।
কথং হসসি রে বিষ্ণো
সর্বং বিষ্ণুময়ং জগৎ।"

১০। যতক্ষণ সেথা সেথা (অর্থাৎ বাহিরে), ততক্ষণ অজ্ঞান; যখন হেথা হেথা (অন্তরের দিকে), তখন জ্ঞান। যার হেথায় আছে (অর্থাৎ অন্তরে ভাব আছে), তার সেথায়ও আছে (অর্থাৎ ভগবৎপদে স্থান আছে)।

ঈশ্বর

১। ভগবান সকলকার ভেতর কিরূপে বিরাজ করেন জান? যেমন চিকের ভেতর বড়লোকের মেয়েরা থাকে। তারা সকলকে দেখতে পায়, কিন্তু তাদের কেউ দেখতে পায় না; ভগবান্ ঠিক সেইরূপে বিরাজ করছেন।

২। প্রদীপের স্বভাব আলো দেয়া; কেউ বা তাতে ভাত রাঁধছে, কেউ জাল করছে, কেউ তাতে ভাগবতপাঠ করছে; সে কি আলোর দোষ? অর্থাৎ কেউ ভগবানের নামে মুক্তিচেষ্টা করছে, কেউ চুরি করতে চেষ্টা করছে; সে কি ভগবানের দোষ?

৩। যার যেমন ভাব তার তেমনি লাভ; ভগবান্ কল্পতরু। তাঁর কাছে যে যা চায়, সে তাই পায়। গরীবের ছেলে লেখাপড়া শিখে হাইকোর্টের জজ হয়ে মনে করে, "আমি বেশ আছি।" ভগবানও তখন বলেন, "তুমি বেশ থাক।" তারপর যখন সে পেনশন নিয়ে ঘরে বসে, তখন সে বুঝতে পারে এ জীবনে কল্লুম কি? ভগবানও তখন বলেন, "তাই তো, তুমি কল্লে কি?"

৪। ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ; ব্রহ্ম যখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকেন, তখন তাঁকে শুদ্ধ ব্রহ্ম বলে; আর যখন সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ইত্যাদি করেন, তখন তাঁর শক্তির কাজ বলে।

৫। একদিন ঈশ্বরীয় কথাপ্রসঙ্গে মথুরবাবু ঠাকুরকে বলেছিলেন, "ভগবানকেও জগতের নিয়ম মেনে চলতে হয়; তিনি ইচ্ছা করলেই সব করতে পারেন না।" ঠাকুর বললেন, "তা কেন হবে গো? তিনি ইচ্ছাময়, তিনি ইচ্ছা করলে সব করতে পারেন।" মথুরবাবু বললেন, "তিনি ইচ্ছা করলে এই লাল জবাফুলের গাছে কি সাদা জবা করতে পারেন?" ঠাকুর বললেন, "তা পারেন বই কি? তাঁর ইচ্ছা হলে এই লাল জবার গাছেই সাদা ফুল ফুটতে পারে।" কিন্তু মথুরবাবু সে কথায় ততটা যেন বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। বাস্তবিকই কয়েকদিন পরে দেখা গেল, দক্ষিণেশ্বরের বাগানে একটা জবাফুলের গাছে এক ডালে সাদা ও অপর ডালে লাল জবা ফুটে আছে। ঠাকুর ডালের গোড়াসুদ্ধ ফুল দুটো এনে মথুরবাবুকে দেখালেন। মথুরবাবু মহা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, "বাবা, আর তোমার সঙ্গে তর্ক করব না।"

৬। সাকার এবং নিরাকার কিরূপ জান? যেমন জল আর বরফ। যখন জল জমাট বেঁধে থাকে তখনই সাকার; আর যখন গলে জল হয় তখনই নিরাকার।

৭। ভীষ্মদেব দেহত্যাগ করবার সময় শরশয্যায় শয়ন করেছিলেন, তাঁর চক্ষু হতে জল পড়েছিল। অর্জুন তা দেখে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, "ভাই, কি আশ্চর্য! পিতামহ, যিনি সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী ও অষ্টবসুর এক বসু, তিনিও দেহত্যাগের সময় মায়াতে কাঁদছেন!" শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে একথা বলাতে তিনি বললেন, "কৃষ্ণ, তুমি বেশ জান আমি সেজন্য কাঁদছি না; এইজন্য কাঁদছি যে, ভগবানের লীলা কিছুই বুঝতে পারি না। যে মধুসূদন-নাম জপ ক'রে লোকে বিপদ থেকে উদ্ধার পায়, সেই মধুসূদন স্বয়ং পাণ্ডবদের সারথি [ও] সখারূপে রয়েছেন, তবুও পাণ্ডবদের বিপদের শেষ নেই।"

৮। মথুরবাবুর সহিত ৺কাশীধাম দর্শনকালে পরমহংসদেব একদিন ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করতে যান। ঠাকুর স্বামীজীকে জিজ্ঞাসা করেন, "ঈশ্বর তো এক, তবে লোকে বহু বলে কেন?" ত্রৈলঙ্গস্বামী মৌনাবলম্বী ছিলেন, তিনি একটি অঙ্গুলি উপরে তুলে একটু ধ্যানস্থ ভাবের মতো হয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে, তাঁকে ধ্যান ক'রে দেখলে বুঝতে পারা যায় যে, তিনি একই - আর বিচার করতে গেলেই বহু বুদ্ধি এসে পড়ে।

৯। যিনিই হয়েছেন সাকার, তিনিই নিরাকার। ভক্তের কাছে তিনিই সাকাররূপে আবির্ভূত হয়ে দর্শন দেন। যেমন মহাসমুদ্র - কেবল অনন্ত জলরাশি, কূলকিনারা কিছুই নেই, কেবল কোথাও কোথাও বেশী ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে বরফ হয়েছে দেখা যায়। সেইরূপ ভক্তের ভক্তিহিমে সাকাররূপ দর্শন হয়। আবার সূর্য উঠলে যেমন বরফ গেলে যায় ও পূর্বের ন্যায় যেমন জল তেমনি হয়ে থাকে, তেমনি জ্ঞানসূর্য উদিত হলে সেই সাকাররূপ বরফ গলে জল হয়ে যায় ও সব নিরাকার হয়।

মায়া

১। মায়ার স্বভাব কেমন জান? যেমন জলের পানা। ঢেইয়ে দিলে, সব পানা সরে গেল। আবার একটু পরেই আপনাআপনি পুরে এল। তেমনি যতক্ষণ বিচার কর, সাধুসঙ্গ কর, যেন কিছুই নেই। একটু পরেই বিষয়বাসনা আবরণ করে।

২। সাপের মুখে বিষ আছে; সে যখন আপনি খায় তখন তার বিষ লাগে না, কিন্তু যখন অন্যকে খায়, তখন বিষ লাগে। তেমনি ভগবানের মায়া আছে বটে, কিন্তু তাঁকে মুগ্ধ করতে পারে না; অন্যকে সে মায়ায় মুগ্ধ করে।

৩। মায়া কাকে বলে জান? - বাপ, মা, ভাই, ভগ্নী, স্ত্রী, পুত্র, ভাগ্নে, ভাইপো, ভাইঝি - এই সব আত্মীয়দের প্রতি টান ও ভালবাসা; আর দয়া মানে - সর্বভূতে আমার হরি আছেন এই জেনে সকলকে সমান ভালবাসা।

৪। যাকে ভূতে পায় সে যদি জানতে পারে যে তাকে ভূতে পেয়েছে, তা হলে ভূত পালিয়ে যায়। মায়াচ্ছন্ন জীব যদি একবার ঠিক জানতে পারে যে, তাকে মায়ায় আচ্ছন্ন করেছে তা হলে মায়া তার নিকট থেকে তখনই পালায়।

৫। জীবাত্মা-পরমাত্মার মধ্যে এক মায়া-আবরণ আছে। এই মায়া-আবরণ না সরে গেলে পরস্পরের সাক্ষাৎ হয় না। যেমন অগ্রে রাম, মধ্যে সীতা এবং পশ্চাতে লক্ষ্মণ। এস্থলে রাম পরমাত্মা ও লক্ষ্মণ জীবাত্মাস্বরূপ, মধ্যে জানকী মায়া-আবরণ হয়ে রয়েছেন। যতক্ষণ মা জানকী মধ্যে থাকেন, ততক্ষণ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান না। জানকী একটু সরে পাশ কাটালে তখন লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পান।

৬। মায়া দুই প্রকার - বিদ্যা এবং অবিদ্যা। তার মধ্যে বিদ্যা মায়া দুই প্রকার - বিবেক এবং বৈরাগ্য। এই বিদ্যা মায়া আশ্রয় ক'রে জীব ভগবানের শরণাপন্ন হয়। আর অবিদ্যা মায়া ছয় প্রকার - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য। অবিদ্যা মায়া 'আমি' ও 'আমার' জ্ঞানে মনুষ্যদিগকে বদ্ধ করে রাখে। কিন্তু বিদ্যা মায়ার প্রকাশে জীবের অবিদ্যা একেবারে নাশ হয়ে যায়।

৭। যেমন যতক্ষণ জল ঘোলা থাকে, ততক্ষণ চন্দ্রসূর্যের প্রতিবিম্ব তাতে ঠিক ঠিক দেখা যায় না, তেমনি মায়া অর্থাৎ 'আমি' এবং 'আমার' এই জ্ঞান যতক্ষণ না যায়, ততক্ষণ আত্মার সাক্ষাৎকার ঠিক ঠিক হয় না।

৮। যেমন সূর্য পৃথিবীকে আলো করে রেখেছেন, কিন্তু সামান্য এক খণ্ড মেঘ সম্মুখে এসে যদি আবরণ করে ফেলে তা হলে আর সূর্য দৃষ্টিগোচর হন না; সেইরূপ সর্বব্যাপী ও সর্বসাক্ষিস্বরূপ সচ্চিদানন্দকে আমরা সামান্য মায়া-আবরণবশতঃ দেখতে পাচ্ছি না।

৯। পানাপুকুরে নেবে যদি পানাকে সরিয়ে দাও আবার তখন এসে জোটে; সেই রকম মায়াকে ঠেলে দিলেও আবার মায়া এসে জোটে। তবে যদি পানাকে সরিয়ে বাঁশ বেঁধে দেওয়া যায়, তা হলে আর বাঁশ ঠেলে আসতে পারে না। সেই রকম মায়াকে সরিয়ে দিয়ে জ্ঞান ভক্তির বেড়া দিতে পারলে আর মায়া তার ভেতর আসতে পারে না। সচ্চিদানন্দই কেবলমাত্র প্রকাশ থাকেন।

১০। দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরবাড়ির নহবতখানার ওপর একটি সাধু এসে কিছুদিন বাস করেছিলেন। সাধু সেই ঘরে কারও সহিত বাক্যালাপ ইত্যাদি কিছু না ক'রে সর্বদা ধ্যানধারণা করতেন। একদিন হঠাৎ মেঘ উঠে চারিদিক অন্ধকার ক'রে ফেললে। কিছুক্ষণ পরে একটা ঝড়ের মতো খুব বাতাস এসে মেঘগুলিকে আবার সরিয়ে দিলে। সাধু তাই দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উক্ত নহবতখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুব হাসি ও নৃত্য করতে লাগলেন। তাই দেখে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি তো ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাক - আজ এত আনন্দ নৃত্যাদি করছ কেন?" সাধু বললেন, "সংসারকা মায়া এয়সা হী হ্যায়।" প্রথমে পরিষ্কার আকাশ, হঠাৎ মেঘ এসে অন্ধকার ক'রে ফেললে, আবার কিছুক্ষণ পরেই যা ছিল তাই রইল।

অবতার

১। বড় বড় বাহাদুরী কাঠ যখন ভেসে আসে, তখন কত লোক তার ওপরে চড়ে চলে যায়। তাতে সে ডোবে না। সামান্য একখানা কাঠে একটা কাক বসলে অমনি ডুবে যায়। তেমনি যখন অবতারাদি আসেন কত শত লোক তাঁকে আশ্রয় ক'রে তরে যায়। সিদ্ধ লোক নিজে কষ্টেসৃষ্টে যায় মাত্র।

২। রেলের ইঞ্জিন আপনি চলে যায় ও কত মালবোঝাই গাড়ি টেনে নিয়ে যায়; অবতারেরাও সেই রকম সহস্র সহস্র লোকদের ঈশ্বরের নিকট নিয়ে যান।

জীবের অবস্থাভেদ

১। মানুষ - যেমন বালিশের খোল; বালিশের ওপর দেখতে কোনটা লাল, কোনটা কাল; কিন্তু সকলের ভেতরে সেই একই তুলো। মানুষ দেখতে কেউ সুন্দর; কেউ কাল; কেউ সাধু, কেউ অসাধু; কিন্তু সকলের ভেতর সেই এক ঈশ্বরই বিরাজ করছেন।

২। সংসারে দুরকম স্বভাবের লোক দেখতে পাওয়া যায় - কতকগুলো কুলোর ন্যায় স্বভাববিশিষ্ট আর কতকগুলো চালুনির ন্যায়। কুলো যেমন ভূষি প্রভৃতি অসার বস্তু সব পরিত্যাগ ক'রে সার বস্তু যে শস্য সেইগুলি আপনার ভেতরে রাখে, সেইরকম কতকগুলি লোক সংসারের অসার বস্তু (কামকাঞ্চনাদি) পরিত্যাগ ক'রে সার বস্তু ভগবানকে গ্রহণ করে। চালুনি যেমন তার বস্তুসকল পরিত্যাগ ক'রে অসার বস্তুগুলি নিজের ভেতর রাখে, সেইরূপ সংসারে কতকগুলি লোক সার বস্তু ঈশ্বরকে পরিত্যাগ ক'রে অসার বস্তু কামকাঞ্চনাদি গ্রহণ করে।

৩। বিষয়ী লোকদের মন গুবরে পোকার মতো। গোবরের পোকা গোবরের ভেতর থাকতে ভালবাসে। যদি গোবর ছাড়া তাদের কিছু দাও, তাহলে ভাল লাগে না। জোর ক'রে যদি পদ্মের ভেতর বসিয়ে দাও তা হলে তারা ছটফট ক'রে মরে। বিষয়ী লোকেদের মনে সেইরকম বিষয়কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাল লাগে না। যদি ঈশ্বরীয় কথা-প্রসঙ্গ হয় তারা সে স্থান ত্যাগ ক'রে যেখানে বাজে কথা হয় সেখানে গিয়ে বসে।

৪। যেমন কতকগুলো মাছ জলে আটকালে আদপে পালাতে চেষ্টা করে না, অমনি পড়ে থাকে; আবার কতকগুলি মাছ পালাবার জন্য লম্ফঝম্ফ করে, কিন্তু পালাতে পারে না; আবার একজাতীয় মাছ আছে, যারা জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যায়। এ সংসারে জীবও সেইরূপ তিন রকমের আছে; যথা - বদ্ধ, মুমুক্ষু ও মুক্ত।

৫। পথে যেতে যেতে রাত হয়ে পড়ায় ও আকাশে মেঘঝড়ের মতো হওয়ায় এক মেছুনী এক মালীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মালী ফুলের ঘরের দাওয়ায় তাকে আশ্রয় দিয়ে যথাসাধ্য তার সেবা করলে, কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম হল না। শেষে সে বুঝতে পারলে বাগানে নানা ফুল ফুটেছে ও সেই ফুলের গন্ধে তার ঘুম হচ্ছে না। সে তখনি আঁশচুপড়িতে জল ছিটিয়ে মাথার কাছে রেখে ঘুমুল। বিষয়বদ্ধ জীবেরও মেছুনীর মতো সংসারে পচা গন্ধ ছাড়া আর কিছুই ভাল লাগে না।

৬। পায়রার ছানার গলায় হাত দিলে যেমন মটর গজ গজ করে, সেইরকম বদ্ধ জীবের সঙ্গে কথা কইলে টের পাওয়া যায়, বিষয়বাসনা তাদের ভেতর গজ গজ করছে। বিষয়ই তাদের ভাল লাগে, ধর্মকথা ভাল লাগে না।

৭। যে মূলো খেয়েছে, তার ঢেঁকুরেতেই টের পাওয়া যায়, তেমনি যে ধার্মিক তার সঙ্গে আলাপ কল্লে সে কেবল ধর্মপ্রসঙ্গই ক'রে থাকে; আর যে বিষয়ী, সে বিষয়ের কথাই বলে থাকে।

৮। দুরকম মাছি আছে - একরকম মধুমাছি, তারা মধু ভিন্ন আর কিছুই খায় না। আর একরকম মাছি মধুতেও বসে, আর যদি পচা ঘা পায় তখনি মধু ফেলে পচা ঘায়ে গিয়ে বসে। সেই রকম দুই প্রকৃতির লোক আছে - যারা ঈশ্বরানুরাগী, তারা ভগবানের কথা ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ করতেই পারে না; আর যারা সংসারাসক্ত জীব, তারা ঈশ্বরীয় কথা শুনতে শুনতে যদি কেহ কাম-কাঞ্চনের কথা কয়, তা হলে ঈশ্বরীয় কথা ফেলে তখনই তাতে মত্ত হয়।

৯। বদ্ধ জীব হরিনাম আপনিও শোনে না, পরকেও শুনতে দেয় না, ধর্ম ও ধার্মিকদের নিন্দা করতে থাকে, কেহ ধ্যান-ধারণা করলে তাকে নানা প্রকার ঠাট্টা করে।

১০। যেমন কুমীরের গায়ে অস্ত্র মারলে অস্ত্র ঠিকরে পড়ে যায় - তার গায়ে কিছুতেই লাগে না, তেমনি বদ্ধ জীবের কাছে ধর্মকথা যতই বল না কেন, কিছুতেই তাদের প্রাণে লাগাতে পারবে না।

১১। সূর্যের কিরণ সব জায়গায় সমান পড়লেও জলের ভেতর, আরশিতে ও সকল স্বচ্ছ জিনিসের ভেতর বেশী প্রকাশ দেখায়। ভগবানের বিকাশ সকল হৃদয়ে সমান হলেও সাধুদের হৃদয়ে বেশী প্রকাশ পাওয়া যায়।

১২। সকল পিঠের এঁটেল একপ্রকার হলেও পুরের যেমন প্রভেদ থাকে - কারও ভেতর নারকেলের পুর, কারও ভেতর ক্ষীরের পুর ইত্যাদি, সেইরূপ মানুষ সব একজাতীয় হলেও গুণে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে।

১৩। জল সব নারায়ণ বটে, কিন্তু সকল জল পান করা যায় না। সকল স্থানে ঈশ্বর আছেন বটে, কিন্তু সকল জায়গায় যাওয়া যায় না। যেমন কোন জলে পা ধোয়া যায়, কোন জলে মুখ ধোয়া যায়, কোন জল বা খাওয়া যায়, আবার কোন কোন জল ছোঁওয়া পর্যন্ত যায় না, তেমনি কোন কোন জায়গায় যাওয়া যায় ও কোন জায়গায় দূরে থেকে গড় ক'রে পালাতে হয়।

১৪। বাঘের ভেতরেও ঈশ্বর আছেন সত্য বটে, কিন্তু বাঘের সুমুখে যাওয়া উচিত নয়। কুলোকের মধ্যেও ঈশ্বর আছেন সত্য, কিন্তু কুলোকের সঙ্গ করা উচিত নয়।

১৫। গুরু এক শিষ্যকে উপদেশ দিয়ে বল্লেন, "সকল পদার্থই নারায়ণ।" শিষ্যও তাই বুঝলেন। একদিন পথের মধ্যে একটি হাতী আসছিল, ওপর হতে মাহুত বললে "সরে যাও।" শিষ্য ভাবলে, "আমি সরে যাব কেন? আমিও নারায়ণ, হাতীও নারায়ণ, নারায়ণের কাছে নারায়ণের ভয় কি?" সে সরল না। শেষে হাতী শুঁড়ে করে তাকে দূরে ফেলে দিলে, তাতে তার বড় ব্যথা লাগল। পরে সে গুরুর কাছে এসে সমস্ত ঘটনা জানালে গুরু বললেন, "ভাল বলেছ - তুমি নারায়ণ, হাতীও নারায়ণ, কিন্তু ওপর থেকে মাহুতরূপী নারায়ণ তোমাকে সাবধান হতে বলেছিলেন, তুমি মাহুত নারায়ণের কথা শুনলে না কেন?"

১৬। সতের রাগ কি রকম জান? যেমন জলের দাগ। জলে একটা দাগ দিলে তখনই যেমন আবার মিলিয়ে যায়, তেমনি সতের রাগ হয় আর তখনি থেমে যায়।

১৭। ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মালে সব ব্রাহ্মণ হয় বটে, কিন্তু কেউ খুব পণ্ডিত হয়, কেউ ঠাকুরপুজো করে, কেউ বা ভাত রাঁধে এবং কেউ বা বেশ্যার দ্বারে গড়াগড়ি যায়।

১৮। যেমন কষ্টিপাথরে সোনা কি পিতল দাগ দেওয়া মাত্র ধরা যায়, তেমনি ভগবানের নিকট সরল কিংবা কপট পরীক্ষা হয়ে থাকে।

১৯। মানুষ দুরকম - মানুষ ও মানহুঁশ। যাঁরা ভগবানের জন্য ব্যাকুল তাঁদের মানহুঁশ বলে; আর যারা কামিনী-কাঞ্চনরূপ বিষয় নিয়ে মত্ত, তারা সব সাধারণ মানুষ।

২০। বদ্ধ সংসারী লোকের কিছুতেই আর হুঁশ হয় না। সংসারে নানা দুঃখকষ্ট ও বিপদে পড়েও তবু তাদের চৈতন্য হয় না। যেমন উট কাঁটা ঘাস খেতে ভালবাসে, খেতে খেতে মুখ দিয়ে রক্ত দর দর ক'রে পড়ে, তবুও সে কাঁটা ঘাস খেতে ছাড়বে না; তেমনি সংসারী লোকেরা কত যে শোক-তাপ পায়, কিছু দিনের পরই আবার যেমন তেমনি।

২১। মুখহলসা, ভেতরবুঁদে, কানতুলসে, দীঘল-ঘোমটা নারী।
আর পানাপুকুরের শীতল জল বড় মন্দকারী॥
- এইরকম লক্ষণ যাদের আছে, সেই সব লোকের কাছ থেকে সাবধান থাকবে।

গুরু

১। গুরু এক কিন্তু উপগুরু অনেক হতে পারে। যাঁর কাছে কিছু শিক্ষা পাওয়া যায়, তাঁকেই উপগুরু বলা যেতে পারে। ভাগবতে আছে, অবধূত এইরূপ ২৪টি উপগুরু করেছিল।

২। একদিন মাঠের ওপর দিয়ে যেতে যেতে অবধূত দেখতে পেলে সামনে ঢাক ঢোল বাজাতে বাজাতে খুব জাঁকজমক ক'রে একটি বর আসছে, আর এক দিকে এক ব্যাধ একমনে আপনার লক্ষ্যের দিকে চেয়ে আছে, এত জাঁক ক'রে যে বর আসছে, সেদিকে একবারও চেয়ে দেখছে না! অবধূত সেই ব্যাধকে নমস্কার ক'রে বললে, "তুমি আমার গুরু। যখন আমি ভগবানের ধ্যানে বসব তখন যেন তাঁর প্রতি ঐরূপ লক্ষ্য থাকে।"

৩। একজন মাছ ধরছে, অবধূত তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, "ভাই, অমুক জায়গা কোন্ পথ দিয়ে যাব?" সে ব্যক্তির ফাতনায় তখন মাছ খাচ্ছে; সে তার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে একমনে ফাতনার দিকে তাকিয়ে রইল। মাছ গেঁথে তখন পেছন ফিরে বললে, "আপনি কি বলছেন?" অবধূত প্রণাম ক'রে বললে, "আপনি আমার গুরু, আমি যখন আপনার ইষ্টের ধ্যানে বসব, তখন যেন এরূপ কাজ শেষ না ক'রে অন্যদিকে মন না দিই।"

৪। একটা চিল একটা মাছ মুখে ক'রে আসছে, তাই দেখে শত শত কাক-চিল তার পেছনে লাগল। তাকে ঠুকরে কামড়ে বিরক্ত ক'রে কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে। সে যেখানে যায় সব কাক-চিলগুলো চেঁচাতে চেঁচাতে তার পেছনে যেতে আরম্ভ করলে। শেষে সে বিরক্ত হয়ে মাছটা ফেলে দিলে, আর একটা চিল এসে যেমন নিলে, সব কাক-চিলগুলো প্রথম চিলটাকে ছেড়ে তার পেছনে যেতে লাগল। প্রথম চিলটি নিশ্চিন্ত হয়ে এক গাছের ডালে চুপ ক'রে বসে রইল। অবধূত সেই চিলের নিরাপদ অবস্থা দেখে প্রণাম ক'রে বললে, "এ সংসারে উপাধি ফেলে দিতে পারলেই শান্তি, নতুবা মহা বিপদ।"

৫। একটি জলাশয়ে এক বক আস্তে আস্তে একটা মাছের দিকে লক্ষ্য ক'রে ধরতে যাচ্ছে, পেছনে এক ব্যাধ সেই বকটিকে লক্ষ্য করছে, কিন্তু বক সে দিকে ভ্রূক্ষেপ করছে না। অবধূত সেই বককে নমস্কার ক'রে বললে, "আমি যখন ধ্যান করতে বসব, তখন যেন ঐরকম চেয়ে না দেখি।"

৬। অবধূতের আর একটি [গুরু] ছিল মৌমাছি। মৌমাছি অনেক দিন ধরে কষ্ট ক'রে মধু সঞ্চয় করতে লাগল। কোথা থেকে একজন মানুষ এসে চাক ভেঙ্গে মধু খেয়ে গেল। তার অনেক দিন ধরে সঞ্চয়ের ধন সে উপভোগ করতে পারলে না। অবধূত তা দেখে মধুকরকে নমস্কার ক'রে বললে, "ঠাকুর, তুমি আমার গুরু, সঞ্চয় করলে পরিণামে কি হয় আমি তা তোমার নিকট হতে শিখলাম।"

৭। "গুরু মিলে লাখ লাখ, চেলা না মিলে এক।" উপদেষ্টা অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু উপদেশমত কার্য করে, এইরূপ লোক অতি অল্প মেলে।

৮। যদি কারও ঠিক ঠিক অনুরাগ আসে ও সে সাধন-ভজনের প্রয়োজন মনে করে তা হলে নিশ্চয়ই তিনি তার সদ্গুরু জুটিয়ে দেন; গুরুর জন্য সাধকের চিন্তা করবার দরকার নেই।

৯। বৈদ্য তিন প্রকার - উত্তম, মধ্যম ও অধম। যে বৈদ্য এসে কেবল নাড়ী টিপে 'ঔষধ খেও' বলে চলে যায়, রোগী ঔষধ খেলে কি না খেলে তার কোন খোঁজ-খবর না নেয়, সে অধম বৈদ্য। আর যে বৈদ্য রোগী ঔষধ খাচ্ছে না দেখে অনেক মিষ্টি কথায় বুঝায় ও 'ঔষধ খেলে ভাল হবে' ইত্যাদি বলে, সে মধ্যম বৈদ্য। আর যে বৈদ্য রোগী কিছুতেই খাচ্ছে না দেখে বুকে হাঁটু দিয়ে জোর ক'রে ঔষধ খাওয়ায়, সে-ই উত্তম বৈদ্য। সেইরূপ যে গুরু বা আচার্য ধর্মশিক্ষা দিয়ে শিষ্যের কোন খোঁজ-খবর না নেন সে গুরু বা আচার্য অধম; আর যিনি শিষ্যদের মঙ্গলের জন্য বারবার বুঝাতে থাকেন যাতে তাঁর উপদেশ সব ধারণা করতে পারে এবং ভালবাসা দেখান, তিনি মধ্যম গুরু। আর শিষ্যেরা ঠিক ঠিক শুনছে না বা পালন করছে না দেখে যে আচার্য খুব জোর-জবরদস্তি পর্যন্ত করেন, তিনি উত্তম আচার্য।

ধর্ম উপলব্ধির বস্তু, পাঠ বা বিচারের বস্তু নয়

১। শাস্ত্রবিচার কতদিন দরকার, জান? যতদিন না সচ্চিদানন্দ সাক্ষাৎকার হন। যেমন ভ্রমর যতক্ষণ না ফুলে বসে, ততক্ষণ গুন্ গুন্ করতে থাকে, আর যখন ফুলের উপর বসে মধুপান করতে থাকে, তখন একেবারে চুপ - কোনও শব্দ করে না।

২। একদিন স্বর্গীয় মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেন দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "অনেক পণ্ডিত লোক বিস্তর শাস্ত্রাদি পাঠ করেন, কিন্তু তাঁদের জ্ঞানলাভ হয় না কেন?" পরমহংসদেব উত্তরে বললেন, "যেমন চিল, শকুনি অনেক উঁচুতে ওড়ে কিন্তু তাদের দৃষ্টি থাকে গো-ভাগাড়ে, তেমনি অনেক শাস্ত্র পাঠ করলে কি হবে? তাদের মন সর্বদা কাম-কাঞ্চনে আসক্ত থাকার দরুণ জ্ঞানলাভ করতে পারে না।"

৩। ঠাকুর বলতেন - গ্রন্থ নয়, গ্রন্থি - গাঁট। বিবেক-বৈরাগ্যের সহিত বই না পড়লে পুস্তকপাঠে দাম্ভিকতা, অহঙ্কারের গাঁট বেড়ে যায় মাত্র।

৪। পরমহংসদেব কোন এক তার্কিক লোককে বলেছিলেন, "যদি এক কথায় বুঝতে পার তো আমার কাছে এস, আর খুব তর্ক-যুক্তি ক'রে যদি বুঝতে চাও তো কেশবের (কেশবচন্দ্র সেন) কাছে যেও।"

৫। যেমন খালি গাড়ুতে জল ভরতে গেলে ভক্ ভক্ ক'রে শব্দ হয়, কিন্তু ভরে গেলে আর শব্দ হয় না, তেমনি যার ভগবান্ লাভ হয়নি সে-ই ভগবান্ সম্বন্ধে নানা গোল করে, আর যে তাঁর দর্শন লাভ করেছে সে স্থির হয়ে ঈশ্বরানন্দ উপভোগ করে।

৬। বিবেক-বৈরাগ্য না থাকলে শাস্ত্র পড়া মিছে। বিবেক-বৈরাগ্য ছাড়া ধর্মলাভও হয় না। এইটি সৎ আর এইটি অসৎ বিচার ক'রে সদ্বস্তু গ্রহণ করা, আর দেহ আলাদা আর আত্মা আলাদা - এইরূপ বিচার-বুদ্ধির নাম বিবেক; বিষয়ে বিতৃষ্ণার নাম বৈরাগ্য।

৭। পাঁজিতে বিশ আড়া জল লেখা আছে, কিন্তু পাঁজি নেংড়ালে এক ফোঁটাও জল বেরোয় না, তেমনি পুঁথিতে অনেক ধর্মকথা লেখা আছে - শুধু পড়লে ধর্ম হয় না - সাধন চাই।

৮। এক বাগানে দুজন লোক বেড়াতে গিছল; তার ভেতর যার বিষয়-বুদ্ধি বেশী সে বাগানে ঢুকেই কটা আম গাছ, কোন গাছে কত আম হয়েছে, বাগানটির দাম কত হতে পারে ইত্যাদি নানা রকম বিচার করতে লাগল। আর একজন বাগানের মালিকের সঙ্গে আলাপ ক'রে গাছতলায় বসে একটি একটি ক'রে আম পাড়তে লাগল আর খেতে লাগল। বল দেখি কে বুদ্ধিমান? আম খাও পেট ভরবে, কেবল পাতা গুণে অত হিসাব-কিতাব ক'রে লাভ কি? যাঁরা জ্ঞানাভিমানী, তাঁরা শাস্ত্র-মীমাংসা, তর্ক-যুক্তি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন; বুদ্ধিমান ভক্তেরা ভগবানের কৃপা লাভ ক'রে এ সংসারে পরমানন্দ ভোগ করেন।

৯। যেমন হাটের বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে কেবল একটা হো হো শব্দ শোনা যায়, কিন্তু যতক্ষণ লোকে ভেতরে প্রবেশ না করে সেই হো হো শব্দ স্পষ্টরূপে বোঝা যায় না; ভেতরে প্রবেশ ক'রে দেখে - কেউ বা দরদস্তুর করছে, কেউ বা পয়সা দিচ্ছে আর জিনিস কিনছে, ইত্যাদি। তেমনি ধর্মজগতের বাইরে থেকে ধর্মের ভাব কিছু বুঝতে পারা যায় না।

১০। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়েছে, কেবল এক ব্রহ্ম আজ পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট হননি। বেদ পুরাণ ইত্যাদি সব মানুষের মুখ দিয়ে বের হয়ে উচ্ছিষ্ট হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত ব্রহ্ম যে কি বস্তু তা কেউ মুখে বলতে পারেনি।

১১। যেমন বালককে রমণসুখ বোঝানো যায় না, সেই রকম বিষয়াসক্ত মায়ামুগ্ধ সংসারী জীবকে ব্রহ্মানন্দ বোঝানো যায় না।

১২। "নাক তেরে কেটে তাক" বোল মুখে বলা সহজ, হাতে বাজানো কঠিন। সেই রকম ধর্মকথা বলা সোজা, কাজে করা বড় কঠিন।

১৩। রামচন্দ্র নামক এক জটাজূটধারী ব্রহ্মচারী একদিন ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করতে এসেছিলেন। তিনি বসে অন্য কোন কথাবার্তা না বলে কেবল 'শিবোঽহম্' 'শিবোঽহম্' করতে লাগলেন। ঠাকুর খানিকক্ষণ চুপ ক'রে থেকে অবশেষে বল্লেন, "কেবল 'শিবোঽহম্' 'শিবোঽহম্' করলে কি হবে? যখন সেই সচ্চিদানন্দ শিবকে হৃদয়ে ধ্যান ক'রে তন্ময় হয়ে গিয়ে বোধে বোধ হয়, সেই অবস্থায় বলা চলে। তা ছাড়া শুধু মুখে 'শিবোঽহম্' বল্লে কি হবে? যতক্ষণ তা না হয়, ততক্ষণ সেব্য-সেবক-ভাবে থাকাই ভাল।" ঠাকুরের এইরূপ নানা উপদেশে ব্রহ্মচারীর চৈতন্য হল এবং তিনি নিজের ভ্রম বুঝতে পারলেন। যাবার সময় দেওয়ালের গায়ে লিখে রেখে গেলেন, "স্বামি-বাক্যে আজ হতে রামচন্দ্র ব্রহ্মচারী সেব্য-সেবক-ভাব প্রাপ্ত হল।"

সংসার ও সাধন

১। লুকোচুরি খেলায় যেমন বুড়ী ছুঁলে চোর হয় না, সেই রকম ভগবানের পাদপদ্ম ছুঁলে আর সংসারে বদ্ধ হয় না। যে বুড়ী ছুঁয়েছে তাকে আর চোর করবার যো নেই। সংসারে সেই রকম যিনি ঈশ্বরকে আশ্রয় করেছেন, তাঁকে আর কোন বিষয়ে আবদ্ধ করতে পারে না।

২। পাড়াগাঁয়ে মাছ ধরবার জন্য বিলের ধারে এবং মাঠে ঘুনি পাতে। ঘুনির ভেতর চিক্ চিক্ ক'রে জল যায় দেখে ছোট ছোট মাছগুলি আনন্দে তার ভেতর চলে যায়, তারা আর বার হতে পারে না, সেইখানে আটকে যায়, পরে একেবারে প্রাণে মরে। দুটো একটা মাছ ঘুনির নিকটে গিয়ে ঐ দেখে একেবারে লাফিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। সংসারেও বাহ্য চাকচিক্য দেখে লোকে সাধ ক'রে প্রবেশ করে, পরে মায়ামোহে জড়িয়ে দুঃখকষ্ট পেয়ে নাশ পায়; আর যাঁরা এই সব দেখে কামকাঞ্চনে আসক্ত না হয়ে ভগবানের পাদপদ্ম আশ্রয় করেন তাঁরাই যথার্থ সুখ ও আনন্দ পান।

৩। রামপ্রসাদ বলেছিলেন, এ সংসার ধোঁকার টাটি। কিন্তু হরিপাদপদ্মে ভক্তি লাভ করতে পারলে এই সংসারই আবার হয়
"- মজার কুটী।
আমি খাই দাই আর মজা লুটি॥
জনক রাজা মহাতেজা তার কিসে ছিল ত্রুটি।
সে এদিক ওদিক দুদিক রেখে খেয়েছিল
দুধের বাটি॥"

৪। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, "সংসারে থেকে ঈশ্বর-উপাসনা কি সম্ভব?" পরমহংসদেব একটু হেসে বললেন, "ও দেশে দেখেছি, সব চিড়ে কোটে; একজন স্ত্রীলোক এক হাতে ঢেঁকির গড়ের ভেতর হাত দিয়ে নাড়ছে, আর এক হাতে ছেলে কোলে নিয়ে মাই খাওয়াচ্ছে, ওর ভেতর আবার খদ্দের আসছে, তার সঙ্গে হিসাব করছে - 'তোমার কাছে ওদিনের এত পাওনা আছে, আজকের এত দাম হল।' এই রকম সে সব কাজ করছে বটে, কিন্তু তার মন সর্বক্ষণ ঢেঁকির মুষলের দিকে আছে; সে জানে যে ঢেঁকিটি হাতে পড়ে গেলে হাতটি জন্মের মতো যাবে। সেইরূপ সংসারে থেকে সকল কাজ কর; কিন্তু মন রেখো তাঁর প্রতি। তাঁকে ছাড়লে সব অনর্থ ঘটবে।"

৫। সংসারের মধ্যে বাস ক'রে যিনি সাধনা করতে পারেন, তিনিই ঠিক বীর সাধক। বীরপুরুষ যেমন মাথায় বোঝা নিয়ে আবার অন্য দিকে তাকাতে পারে, বীর সাধক তেমনি এ সংসারের বোঝা ঘাড়ে ক'রে ভগবানের পানে চেয়ে থাকে।

৬। হিন্দুস্থানী মেয়েরা মাথায় ক'রে ৪।৫ টি জলভরা কলসী নিয়ে যায়। পথে আত্মীয় লোকদের সঙ্গে গল্প করে, সুখ-দুঃখের কথা কয়, কিন্তু তাদের মন থাকে মাথার কলসীর ওপর, যেন সেটি পড়ে না যায়। ধর্মপথের পথিকদেরও সকল অবস্থার ভেতরে ঐ রকম দৃষ্টি রাখতে হবে, মন যেন তাঁর পথ থেকে পড়ে না যায়।

৭। বাউল যেমন দুহাতে দুরকম বাজনা বাজায় ও মুখে গান করে, হে সংসারী জীব! তোমরাও তেমনি হাতে সমস্ত কাজকর্ম কর, কিন্তু মুখে সর্বদা ঈশ্বরের নাম জপ করতে ভুলো না।

৮। নষ্ট স্ত্রীলোক যেমন আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে থেকে সংসারের সব কাজ করে কিন্তু মন পড়ে থাকে উপপতির ওপর - সে কাজ করতে করতে সর্বদা ভাবে যে কখন তার সঙ্গে দেখা হবে; তোমাদেরও সংসারের কাজ করতে করতে মন সর্বদা যেন ভগবানের দিকে পড়ে থাকে।

৯। নির্লিপ্তভাবে সংসার করা কি রকম জান? পাঁকাল মাছের মতন। পাঁকাল মাছ যেমন পাঁকের মধ্যে থাকে কিন্তু তার গায়ে পাঁক লাগে না।

১০। দাঁড়িপাল্লার যে দিক্ ভারী হয় সেই দিক্ ঝুঁকে পড়ে, আর যে দিক্ হাল্কা হয় সেই দিক্ ওপরে উঠে যায়। মানুষের মন দাঁড়িপাল্লার ন্যায় - তার এক দিকে সংসার, আর এক দিকে ভগবান্। যার সংসার, মান-সম্ভ্রম, ইত্যাদির ভার বেশী হয়, তার মন ভগবান্ থেকে উঠে গিয়ে সংসারের দিকে ঝুঁকে পড়ে; আর যার বিবেক-বৈরাগ্য ও ভগবদ্ভক্তির ভার বেশী হয়, তার মন সংসার থেকে উঠে গিয়ে ভগবানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

১১। একজন সমস্ত দিন ধরে আখের ক্ষেতে জল ছেঁচে শেষে ক্ষেতে গিয়ে দেখল যে এক ফোঁটা জলও ক্ষেতে যায়নি, দূরে কতকগুলি গর্ত ছিল তা দিয়ে সমস্ত জল অন্যদিকে বেরিয়ে গেছে। সেই রকম যিনি বিষয়বাসনা, সাংসারিক মান-সম্ভ্রম ইত্যাদির দিকে মন রেখে সাধন করেন, শেষে দেখতে পাবেন যে ঐ সকল বাসনারূপ ছেঁদা দিয়ে তাঁর সমুদয় বেরিয়ে গেছে।

১২। বালক যেমন এক হাত দিয়ে খোঁটা ধরে বন্ বন্ ক'রে ঘুরতে থাকে, একবারও ভয় করে না, কিন্তু তার মন সেই খোঁটার দিকে সর্বদা পড়ে আছে - সে মনে জানে যে, খোঁটাটি ছাড়লেই আমি পড়ে যাব; সংসারেও সেই রকম ভগবানের দিকে মন রেখে সকল কাজ কর, কিন্তু মন যেন তাঁর প্রতি সর্বদা থাকে; তা হলে নিরাপদে থাকবে।

১৩। সংসারে সুখের লোভে অনেকে ধর্মকর্ম ক'রে থাকে, একটু দুঃখকষ্ট পেলে কিংবা মরবার সময় তারা সব ভুলে যায়; যেমন টিয়া পাখি এম্নে সমস্ত দিন রাধাকৃষ্ণ বলে, কিন্তু বেড়ালে যখন ধরে, তখন রাধাকৃষ্ণ ভুলে গিয়ে নিজের বোল 'ক্যাঁ ক্যাঁ' করতে থাকে।

১৪। জলে নৌকা থাকে ক্ষতি নেই, কিন্তু নৌকার ভেতর যেন জল না ঢোকে, তা হলে ডুবে যাবে। সাধক সংসারে থাকুক ক্ষতি নেই কিন্তু সাধকের মনের ভেতর যেন সংসারভাব না থাকে।

১৫। সংসার কেমন? যেমন আমড়া - শাঁসের সঙ্গে খোঁজ নেই, কেবল আঁটি আর চামড়া; খেলে হয় অম্লশূল।

১৬। যেমন কাঁঠাল ভাঙতে গেলে লোকে আগে বেশ ক'রে হাতে তেল মেখে নেয় তা হলে আর হাতে কাঁঠালের আঠা লাগে না; তেমনি এই সংসাররূপ কাঁঠালকে যদি জ্ঞানরূপ তেল হাতে মেখে সম্ভোগ করা যায়, তা হলে কামিনীকাঞ্চনরূপ আঠার দাগ আর মনে লাগতে পারবে না।

১৭। সাপকে ধরতে গেলে তখনই তাকে দংশন ক'রে দেবে, কিন্তু যে ব্যক্তি ধুলোপড়া জানে, সে সাতটা সাপকে ধরে গলায় জড়িয়ে বেশ খেলা দেখাতে পারে; তেমনি বিবেকবৈরাগ্যরূপ ধুলোপড়া শিখে কেউ যদি সংসার করে, তাকে আর সাংসারিক মায়া-মমতায় আবদ্ধ করতে পারে না।

১৮। ভেতরে যার যে ভাব থাকে, তার কথাবার্তায় তা বেরিয়ে পড়ে; যেমন মূলো খেলে তার ঢেকুরে মূলোর গন্ধ বেরোয়। তেমনি সংসারী লোকেরা সাধুসঙ্গ করতে এসে বিষয়ের কথাই বেশী কয়ে থাকে।

১৯। মনই সব জানবে। জ্ঞানই বলো আর অজ্ঞানই বলো, সবই মনের অবস্থা। মানুষ মনেই বদ্ধ ও মনেই মুক্ত, মনেই সাধু এবং মনেই অসাধু, মনেই পাপী ও মনেই পুণ্যবান। সংসারী জীব মনেতে সর্বদা ভগবানকে স্মরণ-মনন করতে পারলে তাদের আর অন্য কোন সাধনের দরকার হয় না।

২০। জ্ঞানলাভ হলে তারা সংসারে কি রকম ভাবে থাকে জান? যেমন সার্সির ঘরে বসে থাকলে ভেতরের ও বাহিরের - দুই দেখতে পায়।

২১। গীতা পড়লে যা হয় আর দ্বাদশবার 'গীতা' শব্দ উচ্চারণ করলে তাই বোঝায়, যেমন - 'গী তাগী তাগী তাগী'। কি না হে জীব! সব ত্যাগ ক'রে ভগবানের পাদপদ্ম আশ্রয় কর।

সাধনের অধিকারী

১। যেমন আম, পেয়ারা ইত্যাদি আস্ত ফল ঠাকুরের সেবায় ও সকল কাজে লাগতে পারে কিন্তু একবার কাকে ঠুকরে দাগী করলে আর দেবসেবায় সে ফল দেওয়া যায় না, ব্রাহ্মণকে দান করা যেতে পারে না, আপনিও খাওয়া উচিত নয়; সেইরূপ পবিত্রহৃদয় বালক ও যুবাদের ধর্মপথে লয়ে যাবার চেষ্টা করা উচিত। কেন না তাদের ভেতর বিষয়-বুদ্ধি একেবারে প্রবেশ করেনি। একবার বিষয়-বুদ্ধি ঢুকলে পরমার্থপথে লয়ে যাওয়া ভার।

২। আমি ছেলেদের এত ভালবাসি কেন জান? ছেলেবেলা তাদের মন ষোল আনা নিজের কাছে থাকে, ক্রমে ভাগ হয়ে পড়ে। বে' হলে আট আনা স্ত্রীর উপর যায়, ছেলে হলে আবার চার আনা তাদের প্রতি যায়, বাকি চার আনা মা-বাপ, মান-সম্ভ্রম, বেশভূষা ইত্যাদিতে চলে যায়; এইজন্য ছেলেবেলায় যারা ঈশ্বরলাভের চেষ্টা করে তারা সহজে তাঁকে লাভ করতে পারবে। বুড়োদের হওয়া বড় কঠিন।

৩। যেমন টিয়া পাখীর গলায় কাঁটি উঠলে আর পড়ে না, ছেলেবেলায় শেখালে শীঘ্র পড়ে, তেমনি বুড়ো হলে সহজে ঈশ্বরে মন যায় না, ছেলেবেলায় তাদের মন অল্পতেই স্থির হয়।

৪। এক সের দুধে এক ছটাক জল থাকলে সহজে অল্প জ্বাল দিয়ে ক্ষীর করা যায়, কিন্তু এক সের দুধে তিন পোয়া জল থাকলে সহজে ক্ষীর হয় না, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে জ্বাল দিতে হয়, তবে হয়; সেই রকম বালকের মনে বিষয়-বাসনা খুব কম, এইরূপ যে একটুতে ঈশ্বরের দিকে যায়, কিন্তু বুড়োদের মনে বিষয়-বাসনা গজ গজ করে; তাইতে তাদের মন সহজে তাঁর দিকে যায় না।

৫। যেমন কচি বাঁশ অতি সহজে নোয়ানো যায়, পাকা বাঁশ নোয়াতে গেলে ভেঙ্গে যায়, তেমনি ছেলেদের মন সহজে ঈশ্বরে নিয়ে যাওয়া যায়; কিন্তু বুড়োদের মন সহজে ঈশ্বরের দিকে টানতে গেলে ছেড়ে পালায়।

৬। মানুষের মন যেন সরষের পুঁটলী। সরষের পুঁটলী একবার ছড়িয়ে গেলে যেমন কুড়ানো ভার হয়ে উঠে, তেমনি মানুষের মন একবার সংসারে ছড়িয়ে গেলে তখন স্থির করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। বালকের মন ছড়ায়নি, অল্পতেই স্থির হয়; কিন্তু বুড়োদের ষোল আনা মন সংসারে ছড়িয়ে রয়েছে, সংসার থেকে মন তুলে ঈশ্বরে স্থির করা বড় শক্ত।

৭। সূর্যোদয়ের পূর্বে দধি মন্থন করলে যেমন উত্তম মাখন উঠে থাকে, বেলা হলে কিন্তু আর ভাল মাখন তোলা যায় না; সেইরূপ বাল্যকালে যারা ঈশ্বরানুরাগী হয় ও সাধন-ভজন করে, তাদের ঈশ্বরলাভ হয়ে থাকে।

৮। বাসনাহীন মন কেমন জান? যেন শুকনো দেশলাই - একবার ঘষলে দপ করে জ্বলে উঠে। আর ভিজে হলে ঘষতে ঘষতে কাঠি ভেঙ্গে গেলেও জ্বলে না। সেইমত সরল, সত্যনিষ্ঠ, নির্মল-স্বভাব লোককে একবার উপদেশ দিলেই ঈশ্বরানুরাগের উদয় হয়। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিকে শত শতবার উপদেশ করলেও কিছু হয় না।

বিভিন্ন প্রকারের সাধন

১। দুই রকমের সাধক দেখা যায় - যেমন, বাঁদরের ছানা এবং বিল্লীর ছানা। বাঁদরের ছানা আগে তার মাকে ধরে, পরে তার মা তাকে সঙ্গে ক'রে যেখানে সেখানে নিয়ে বেড়ায়। বেড়ালের ছানা কেবল এক জায়গায় বসে মিউ মিউ করতে থাকে, তার মা যখন যেখানে ইচ্ছা হয় ঘাড়ে ধরে নিয়ে যায়। তেমনি জ্ঞানী বা কর্মী সাধক বাঁদরের ছানার ন্যায় পুরুষকার দ্বারা ঈশ্বরলাভ করতে চেষ্টা ক'রে থাকে। আর ভক্ত সাধকেরা ঈশ্বরকে সকলের কর্তা জ্ঞান করে, তাঁর চরণে বিড়াল-ছানার ন্যায় নির্ভর ক'রে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকে।

২। এক ব্যক্তি যেমন কারও পিতা, কারও জ্যাঠা, কারো খুড়া, কারো মেসো, কারো ভগ্নীপতি, কারো শ্বশুর ইত্যাদি ইত্যাদি। এস্থলে ব্যক্তি এক হলেও কিন্তু সম্বন্ধভেদে অনেক প্রকার প্রভেদ রয়েছে, তেমনি সেই এক সচ্চিদানন্দকে ভক্তেরা শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর প্রভৃতি নানাভাবে উপাসনা করে।

৩। যার যেমন ভাব, তার তেমনি লাভ হয় অর্থাৎ যে তাঁকেই চায়, সে তাঁকেই পায়। আর যে তাঁর ঐশ্বর্য্য কামনা করে, সে তাই পেয়ে থাকে।

৪। রাজবাড়িতে ভিক্ষা করতে গিয়ে যে লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি সামান্য বস্তু প্রার্থনা করে, সে অতি নির্বোধ। রাজাধিরাজ ভগবানের দ্বারস্থ হয়ে জ্ঞান ভক্তি ইত্যাদি রত্ন প্রার্থনা না ক'রে অষ্টসিদ্ধাই প্রভৃতি তুচ্ছ বস্তুর নিমিত্ত যে প্রার্থনা করে সে বড়ই নির্বোধ।

৫। ভক্ত কিংবা জ্ঞানীর ভাব বাইরে থেকে বোঝা বড় কঠিন হয়ে থাকে। যেমন হাতীর দুরকম দাঁত দেখা যায় - বাইরের দাঁত কেবল দেখাবার, তার দ্বারা খাওয়া চলে না; আর এক রকম দাঁত মুখের ভেতরে আছে, তার দ্বারা খেয়ে থাকে। তেমনি অনেক সময় সাধকেরা আপনার ভাব গোপন রেখে অন্য রকম দেখান।

৬। যোগী দুই প্রকার - গুপ্ত যোগী ও ব্যক্ত যোগী। গুপ্ত যোগী যাঁরা, তাঁরা গোপনে গোপনে ভগবানের সাধন ভজন ক'রে থাকেন, লোককে আদপেও জানতে দেন না। আর ব্যক্ত যোগী যাঁরা, তাঁরা বাহ্যিক যোগদণ্ড ইত্যাদি ধারণ ক'রে লোকের সঙ্গে ঐ সব প্রসঙ্গই করে থাকেন।

উত্তম ভক্ত

১। পাথর হাজার বৎসর জলের মধ্যে পড়ে থাকলেও তার ভেতর জল কখনও ঢোকে না, কিন্তু মাটিতে জল লাগলে তখনি গলে যায়। যারা বিশ্বাসী ও ভক্ত, তারা হাজার হাজার আপদ-বিপদের মধ্যে পড়লেও হতাশ হয় না, কিন্তু অবিশ্বাসী মানুষের মন সামান্য কারণে টলে যায়।

২। প্রহ্লাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে ভগবান্ বল্লেন, "তুমি কি বর চাও?" প্রহ্লাদ বল্লে, "ঠাকুর, যারা আমাকে কষ্ট-যন্ত্রণা দিয়েছে, তাদের তুমি ক্ষমা কর। তাদের শাস্তি দিলে তোমাকেই কষ্ট সহ্য করতে হবে; কারণ তুমি তো সর্বভূতেই অবস্থান কচ্ছ।"

৩। ভক্ত কেশবচন্দ্রকে দেখবার ঠাকুরের বড় সাধ হয়েছিল। তখন কেশববাবু ব্রাহ্মভক্তদের সঙ্গে ৺জয়গোপাল সেনের বেলঘরের বাগানে অবস্থান করছিলেন। ঠাকুর হৃদয় মুখুজ্যেকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে বেলঘরের বাগানে উপস্থিত হলেন। কেশববাবু তখন ব্রাহ্মভক্তদের সঙ্গে পুকুরে স্নান করবার উদ্যোগ করছেন। ঠাকুর তাঁকে দেখে বল্লেন, "এরই ল্যাজ খসেছে।" এই শুনে ব্রাহ্মভক্তেরা সবাই হেসে উঠলেন। কেশববাবু তাদের বল্লেন, "তোমরা হেসো না, ইনি যা বলছেন তার মানে আছে।" ঠাকুর তখন বল্লেন, "ব্যাঙাচির যতদিন ল্যাজ থাকে ততদিন জলে থাকে; ল্যাজ খসে গেলে জলেও থাকতে পারে ডাঙ্গাতেও থাকতে পারে। তেমনি ভগবানকে চিন্তা ক'রে যার অবিদ্যা দূর হয়ে গেছে, সে সচ্চিদানন্দ-সাগরে ডুবে থাকতেও পারে আবার সংসারেও থাকতে পারে।"

সাধনে বিঘ্ন

১। যেমন জালার ভেতর কোনখানে একটি ছোট ছিদ্র থাকলে ক্রমে ক্রমে সব জল বেরিয়ে যায়, তেমনি সাধকের ভেতরেও একটু সংসারাসক্তি থাকলে সব সাধনা বিফল হয়ে থাকে।

২। কাঁচা মাটিতে গড়ন হয়, পোড়া মাটিতে আর গড়ন চলে না। যার হৃদয় একেবারে বিষয়বুদ্ধিতে পুড়ে গেছে, তাতে আর পারমার্থিক ভাব ধরে না।

৩। চিনিতে বালিতে মিশে থাকলে পিঁপড়ে যেমন বালি ফেলে চিনি খায়, তেমনি সাধু ও পরমহংসেরা এ সংসারে সদ্বস্তু যে সচ্চিদানন্দ তাঁকেই গ্রহণ করে, আর অসদ্বস্তু যে কাম-কাঞ্চন, সে সমস্ত ত্যাগ করে।

৪। কাগজে তেল লাগলে তাতে আর লেখা চলে না, তেমনি জীবে কাম-কাঞ্চনরূপ তেল লাগলে তাতে আর সাধন চলে না। সে তেলমাখা কাগজ খড়ি দিয়ে ঘষে নিলে তাতে লেখা যায়, তেমনি জীবে কাম-কাঞ্চনরূপ তেল লাগলে ত্যাগরূপ খড়ি দিয়ে ঘষে নিলে তবে সাধন চলে।

৫। যে সকল লোক নিজে কখন ধর্মচর্চা করে না, অন্যকেও ধ্যান [কি] পূজা করতে দেখলে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, ধর্ম ও ধার্মিকদের নিন্দা করে, সাধন-অবস্থায় কখনও এরূপ লোকদের সঙ্গ করবে না। তাদের কাছ থেকে একেবারে দূরে থাকবে।

৬। গরুর পালে যদি অন্য কোন জন্তু এসে ঢোকে তা হলে সব গরুগুলো তাকে গুঁতিয়ে তাড়িয়ে দেয়, কিন্তু গরু এলে তার সঙ্গে গা চাটাচাটি করে। সেই রকম যখন ভক্তের সঙ্গে ভক্তের দেখা হয় তখন তারা উভয়ে ধর্মকথা কয়, বড় আনন্দ করে আর হঠাৎ সে সঙ্গ ত্যাগ করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বিজাতীয় লোক এলে তার সঙ্গে মেশামেশি করে না।

৭। যে পুকুরে অল্প জল, তার যেমন জল পান করতে গেলে ওপর থেকে আস্তে আস্তে নেড়ে জল খেতে হয়, বেশী নাড়তে নেই, নাড়লে তার ভেতর হতে ময়লা উঠে জল ঘোলা হয়ে যায়, তেমনি যদি সচ্চিদানন্দলাভ করতে চাও তা হলে তুমি গুরুবাক্যে বিশ্বাস ক'রে ধীরে ধীরে সাধন কর। মিছে কেবল শাস্ত্রবিচার [আর] তর্ক করো না, ক্ষুদ্র মন অল্পতেই গুলিয়ে যায়।

৮। ভূত ছাড়বে কেমন ক'রে বল? যে সরষে দিয়ে ভূত ছাড়াবে তারই মধ্যে ভূত ঢুকে বসে আছে; যে মন দিয়ে সাধন-ভজন করবে তাই যদি বিষয়াসক্ত হয়ে পড়ে, তা হলে সাধন-ভজন কি ক'রে হবে?

৯। মন-মুখ এক করাই হচ্ছে প্রকৃত সাধন। নতুবা মুখে বলছি, 'হে ভগবান্! তুমি আমার সর্বস্ব ধন' এবং মনে বিষয়কেই সর্বস্ব জেনে বসে রয়েছি - এইরূপ লোকের সকল সাধনাই বিফল হয়।

১০। বাসনার লেশমাত্র থাকতে ভগবানলাভ হয় না। যেমন সূতোতে একটু ফেঁসো বেরিয়ে থাকতে ছুঁচের ভেতর যায় না। মন যখন বাসনারহিত হয়ে শুদ্ধ হয়, তখনই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়।

১১। যারা ঈশ্বরলাভের জন্য সাধন-ভজন করতে চায় তারা যেন কোন রকমে কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত না হয়ে পড়ে, কামিনী-কাঞ্চনের সংস্রব থাকলে কোন কালেও তাদের সিদ্ধাবস্থালাভের উপায় নেই। যেমন খই ভাজবার সময় যে খইটি খোলার উপর থেকে ঠিকরে বাইরে পড়ে, তাতে কোন দাগ লাগে না, কিন্তু গরম বালির খোলায় থাকলে কোন কোন স্থানে কাল দাগ লাগে।

১২। বিষয়, ছেলে, কিংবা মান-সম্ভ্রমের জন্য কেহ যেন কামনা ক'রে ঈশ্বরের সাধনা না করে, যে শুধু সচ্চিদানন্দ-লাভের জন্য তাঁর নিকট প্রার্থনা করে, তার নিশ্চয়ই ঈশ্বর-লাভ হয়।

১৩। যেমন বাতাসে জল নড়লে ঠিক প্রতিবিম্ব দেখা যায় না, তেমনি মন স্থির না হলে তাতে ভগবানের প্রকাশ হয় না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মন চঞ্চল হয়। এইজন্য যোগীরা আগে কুম্ভক দ্বারা মন স্থির ক'রে ভগবানের ধ্যান-ধারণা করেন।

১৪। ভাবের ঘরে যার চুরি না থাকে, তারই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়। অর্থাৎ কেবল সরলভাবে ও বিশ্বাসেই তাঁকে পাওয়া যায়।

১৫। যেমন সাপ দেখলে লোকে বলে থাকে, "মা মনসা, মুখটি লুকিয়ে রেখো, আর ল্যাজটি দেখিয়ো", তেমনি যুবতী স্ত্রীলোক দেখলে মা বলে নমস্কার করা উচিত ও তাদের মুখের দিকে না চেয়ে পায়ের দিকে চাইবে। তা হলে আর প্রলোভনের আর পতনের আশঙ্কা থাকবে না।

১৬। বিদ্যাশক্তিই হউক বা অবিদ্যাশক্তিই হউক, সাধু-সন্ন্যাসী ও ভক্তমাত্রেই সব স্ত্রীলোককে মা আনন্দময়ীর রূপ বলে জানবে।

১৭। খুব জনশূন্য স্থানে যুবতী স্ত্রীলোককে দেখে যে মা বলে চলে যেতে পারে, তাকেই ঠিক ঠিক ত্যাগী বলা যায়, আর, যে লোক সভার মাঝখানে ত্যাগী সেজে থাকে, তাকে প্রকৃত ত্যাগী বলা যায় না।

১৮। অভিমানের জড় মরেও মরে না, যেমন ছাগলটাকে কেটে ফেলে তার ধড় মুণ্ডু হতে পৃথক্ করলেও কিছুক্ষণ ধরে নড়তে থাকে।

১৯। অভিমানশূন্য হওয়া বড় কঠিন। প্যাঁজ রসুনকে ছেঁচে কোন পাত্রে রেখে, তার পর পাত্রটিকে শতবার ধুয়ে ফেললেও তার গন্ধ যেমন কিছুতেই যায় না, সেই প্রকার অভিমানের লেশ কিছু না কিছু থেকে যায়।

২০। ঠিক ঠিক সন্ন্যাসী বা ত্যাগীর লক্ষণ কিরূপ জান? তারা কামিনী-কাঞ্চনের কোনরূপ সংস্পর্শে থাকবে না। এমন কি, স্বপ্নেও যদি কামিনী-সহবাস হচ্ছে বলে জ্ঞান হয় এবং তদ্দ্বারা রেতঃস্খলন হয়, কিংবা অর্থের ওপর আসক্তি জন্মায়, তা হলে এত দিনের সাধন-ভজন সব নষ্ট হয়ে যায়।

২১। ভগবান্ কল্পতরু। কল্পতরুর নিকট বসে যে যা-কিছু প্রার্থনা করে, তাই তার লাভ হয়। এই নিমিত্ত সাধন-ভজনের দ্বারা যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন খুব সাবধানে কামনা ত্যাগ করতে হয়। কেমন জান? -

এক ব্যক্তি কোন সময় ভ্রমণ করতে করতে অতি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হয়। পথে রৌদ্রের তাপে এবং পথভ্রমণের ক্লেশে অতিশয় ক্লান্ত ও ঘর্মাক্তকলেবর হয়ে কোন একটি বৃক্ষের নিম্নে উপবেশন ক'রে শ্রান্তি দূর করতে করতে মনে মনে ভাবলে যে, এই সময়ে যদি একটি উত্তম শয্যা মেলে, তা হলে তাতে অতি সুখে নিদ্রা যাই। পথিক যে কল্পতরুর নিম্নে বসে ছিল, তা সে জানত না। মনে মনে যেমন এই বাসনা উঠল তৎক্ষণাৎ সেইখানে উত্তম শয্যা এসে পড়ল। পথিক অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে তাহাতেই শয়ন করলে ও মনে মনে ভাবতে লাগল, এই সময় যদি একটি স্ত্রীলোক এসে আমার পদসেবা করে, তা হলে অতি সুখে শয়ন করতে পারি। এই সঙ্কল্প হতে না হতেই তখনই এক যুবতী পথিকের পদতলে এসে উপবেশনপূর্বক তার সেবা করতে লাগল। পথিকের এই দেখে আহ্লাদের আর সীমা রইল না। তারপর তার খুব ক্ষুধা পেতে লাগল ও সে মনে করলে যা ইচ্ছা করেছিলুম তা পেলুম, তবে কি খাবার কিছু জিনিস পাব না? বলতে না বলতে তার নিকট অমনি নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য এসে জুটল। পথিক সেগুলি দিয়ে তখনই উদর পূর্ণ ক'রে সেই শয্যায় শয়নপূর্বক সেদিনকার সব ঘটনা ভাবছে; এমন সময় তার মনে হল যে এ সময় যদি হঠাৎ একটা বাঘ এসে পড়ে, তাহলেই বা কি করা যায়। যেমন এইটি মনে হওয়া অমনি এক প্রকাণ্ড বাঘ লাফ দিয়ে এসে তাকে ধরলে এবং তার ঘাড় থেকে রক্ত পান করতে লাগল। অবশেষে পথিকের জীবন শেষ হল। এই সংসারে জীবেরও ঠিক এইরূপ দশা ঘটে থাকে। ঈশ্বরসাধন করতে গিয়ে বিষয়, ধন, জন অথবা মান, যশ ইত্যাদির কামনা করলে তা কিছু কিছু লাভ হয় বটে কিন্তু শেষে ব্যাঘ্রেরও ভয় থাকে। অর্থাৎ রোগ, শোক, তাপ, মান, অপমান ও বিষয়নাশরূপ ব্যাঘ্র স্বাভাবিক ব্যাঘ্র হতেও লক্ষগুণে যন্ত্রণাদায়ক।

২২। এক ব্যক্তির মনে হঠাৎ বৈরাগ্যভাব উদয় হতে আত্মীয় ভাইদের নিকট বলল, "সংসার আমার ভাল লাগছে না। এখনি আমি কোন নির্জন স্থানে গিয়ে ঈশ্বর-আরাধনা করব।" তার আত্মীয়েরা এই শুভ সঙ্কল্পে সম্মতি দিল। উক্ত ব্যক্তি বাড়ি হতে বাহির হয়ে ক্রমে এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হয়ে ঘোরতর তপস্যা করতে আরম্ভ করলে। ক্রমান্বয়ে বার বৎসর কাল তপস্যা ক'রে ও কিছু কিছু সিদ্ধাই লাভ ক'রে পুনরায় বাড়িতে ফিরল। তার আত্মীয়-স্বজনেরা অনেকদিন পরে তাকে দেখে সকলেই আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল ও কথাবার্তা-প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, "এতদিন তপস্যা ক'রে কি জ্ঞানলাভ করলে?" তখন সেই ব্যক্তি ঈষৎ হাস্য ক'রে সম্মুখে একটি হাতী চলে যাচ্ছে দেখে, হাতীর নিকট গিয়ে তার গা তিনবার স্পর্শ ক'রে যেমন বললে, 'হাতী তুই মরে যা', অমনি হাতীটা তার স্পর্শে মৃতবৎ হয়ে গেল; কিছুক্ষণ পরে আবার গায়ে হাত দিয়ে যেমন বললে, 'হাতী বাঁচ্' অমনি হাতী বেঁচে উঠল।

তারপর বাড়ির সম্মুখে নদীর ধারে গিয়ে মন্ত্রবলে এপার হতে পরপারে চলে গেল, আবার ঐভাবে নদী পার হয়ে এল। তার ভাইয়েরা এই সব দেখে খুব আশ্চর্য হল বটে, কিন্তু তপস্বী-ভাইকে বলতে লাগল - "ভাই, এতদিন কেবল বৃথা তপস্যা করেছ; হাতী মরল ও বাঁচল তাতে তোমার কি লাভ হল? আর তুমি বার বছর ধরে কঠোর তপস্যা ক'রে নদী পারাপার করতে শিখেছ; আমরা এক পয়সা খরচ করে থাকি। অতএব তুমি কেবল বৃথা সময় নষ্ট করেছ।" ভাইদের নিকট এইরূপ শ্লেষপূর্ণ কথা শুনে তার যথার্থই হুঁশ হল ও সে বলতে লাগল, "যথার্থই আমার নিজের কি হল?" এই বলে তৎক্ষণাৎ ভগবানের দর্শনলাভের জন্য পুনরায় ঘোরতর তপস্যা করতে চলে গেল।

২৩। নিজেকে বেশী চতুর মনে করা উচিত নয় - যেমন কাক খুব চতুর, কিন্তু বিষ্ঠা খেয়ে মরে, তেমনি সংসারক্ষেত্রে যারা বেশী চালাকি করতে যায়, তারাই কেবল ঠকে থাকে।

২৪। একদিন গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে এক হাতে একটা টাকা নিয়ে আর এক হাতে মাটি নিয়ে 'মাটিই টাকা, টাকাই মাটি', এইরূপ বিচার ক'রে উভয়কে যখন গঙ্গার জলে ফেলে দিলুম, তখন মনে একটু ভয় ও ভাবনা এল। ভাবলুম - মা লক্ষ্মী যদি রাগ করেন ও তিনি যদি খেতে না দেন। তার পরে মনে বললুম, "মা লক্ষ্মী, তুমিই আমার হৃদয়ে থাক, তোমার ঐশ্বর্য আমি চাই না।"

২৫। ঈশ্বর দুবার হাসেন। যখন ভায়ে ভায়ে দড়ি ধরে জমি বখরা করে নেয় আর বলে, "এ দিকটা আমার, ও ঐ দিকটা তোমার", তখন একবার হাসেন। আর একবার হাসেন যখন লোকের অসুখ কঠিন হয়ে পড়েছে, আত্মীয়স্বজনেরা সকলে কান্নাকাটি কচ্ছে, বৈদ্য এসে বলছে, "ভয় কি? আমি ভাল করে দেব।" বৈদ্য জানে না যে, ঈশ্বর যদি মারেন, তবে কার সাধ্য তাকে রক্ষা করে।

২৬। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, "হে অর্জুন, অষ্ট সিদ্ধির মধ্যে একটি সিদ্ধিও থাকলে পরে আমার যে সেই পরম ভাব, তা তুমি লাভ করতে পারবে না।" অতএব যারা ঠিক ঠিক ভক্ত ও জ্ঞানী, তারা যেন কোনরূপ সিদ্ধি কামনা না করে।

২৭। লক্ষ্মীনারায়ণ নামক একজন মাড়োয়ারী সৎসঙ্গী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুরকে দর্শন করতে আসেন। ঠাকুরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বেদান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। ঠাকুরের সহিত ধর্মপ্রসঙ্গ ক'রে ও তাঁর বেদান্ত সম্বন্ধে আলোচনা শুনে তিনি বড়ই প্রীত হন। পরিশেষে ঠাকুরের নিকট হতে বিদায় নেবার সময় বলেন, "আমি দশ হাজার টাকা আপনার সেবার নিমিত্ত দিতে চাই।" ঠাকুর এই কথা শোনবামাত্র, মাথায় দারুণ আঘাত লাগলে যেরূপ হয়, মূর্ছাগতপ্রায় হলেন। কিছুক্ষণ পরে মহাবিরক্তি প্রকাশ ক'রে বালকের ন্যায় তাকে সম্বোধন ক'রে বললেন, "শালা, তুম্ হিঁয়াসে আভি উঠ্ যাও। তুম্ হামকো মায়াকা প্রলোভন দেখাতা হ্যায়।" উক্ত মাড়োয়ারী ভক্ত একটু অপ্রতিভ হয়ে ঠাকুরকে বললেন, "আপ্ আভি থোড়া কাঁচা হ্যায়।" ইহার উত্তরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, "ক্যায়সা হ্যায়।" মাড়োয়ারী ভক্ত বললেন, "মহাপুরুষ লোগোকোঁ খুব উচ্চ অবস্থা হোনেসে ত্যাজ্য গ্রাহ্য এক সমান বরাবর হো যাতা হ্যায়, কোই কুছ্ দিয়া অথবা লিয়া উসমে উনকা চিত্তমে সন্তোষ বা ক্ষোভ কুছ্ নেহি হোতা।" ঠাকুর ঐ কথা শুনে ঈষৎ হেসে তাকে বুঝাতে লাগলেন, "দেখ, আর্শিতে কিছু অপরিষ্কার দাগ থাকলে যেমন ঠিক ঠিক মুখ দেখা যায় না, তেমনি যার মন নির্মল হয়েছে, সেই নির্মল মনে কামিনী-কাঞ্চন-দাগ পড়া ঠিক নয়।" ভক্ত মাড়োয়ারী বললেন, "বেশ কথা, তবে হৃদয়, যে আপনার সেবা করে, না হয় তার নামে আপনার সেবার জন্য টাকা থাক।" তদুত্তরে ঠাকুর বললেন, "না, তাও হবে না। কারণ, তার নিকট থাকলে যদি কোন সময় আমি বলি যে অমুককে কিছু দাও বা অন্য কোন বিষয়ে আমার খরচ করতে ইচ্ছা হয়, তাতে যদি সে দিতে না চায় তার মনে সহজেই এই অভিমান আসতে পারে যে, ও টাকা তো তোর নয়, ও আমার জন্য দিয়েছে। এও ভাল নয়।" মাড়োয়ারী ভক্ত ঠাকুরের এই কথা শুনে আশ্চর্য হলেন এবং ঠাকুরের এই অদৃষ্টপূর্ব ত্যাগভাব দেখে নিরতিশয় প্রীত হয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন।

২৮। টাকার অহঙ্কার করতে নেই। যদি বল আমি ধনী, ধনীর আবার তারে বাড়া তারে বাড়া আছে। সন্ধ্যার পর যখন জোনাকী পোকা ওঠে, সে মনে করে, আমি এই জগৎকে আলো দিচ্ছি; কিন্তু যেই নক্ষত্র উঠল, অমনি তার অভিমান চলে গেল। তখন নক্ষত্রেরা মনে করে, আমরা জগৎকে আলো দিচ্ছি; কিন্তু পরে যখন চন্দ্র উঠল, তখন নক্ষত্রেরা লজ্জায় মলিন হয়ে গেল। চন্দ্র মনে করলে, আমার আলোয় জগৎ হাসছে। দেখতে দেখতে অরুণোদয় হল, তখন চন্দ্র মলিন হয়ে গেল। খানিক পরে আর দেখা গেল না। ধনীরা যদি এগুলি ভাবে, তাহলে আর তাদের ধনের অহঙ্কার থাকে না।

২৯। "এক কৌপীন কা ওয়াস্তে।" একজন সাধু গুরূপদেশ নিয়ে ভগবানের সাধন-ভজন করবার উদ্দেশ্যে কোন গ্রামের কাছে একটি নির্জন প্রান্তরের মধ্যে সামান্য একটি পর্ণকুটীর ক'রে তার মধ্যে বাস করতে লাগলেন ও সাধন-ভজন করতে লাগলেন। তিনি প্রত্যহ প্রত্যূষে উঠে স্নান ইত্যাদি ক'রে তাঁর ভিজে কাপড় ও কৌপীন কুটীরের কাছে একটি গাছে শুকোবার জন্য রেখে দিতেন। সাধু যখন ভিক্ষার জন্য বেরিয়ে যেতেন, সেই সময় ইঁদুর এসে তাঁর সেই কৌপীন কেটে দিত। সাধু পরদিন গ্রামে গিয়ে আবার নূতন কৌপীন ভিক্ষা ক'রে আনতেন। অল্পদিন পরে সাধু স্নানান্তে আবার ঐ ভিজে কৌপীন কুটীরের ওপর শুকোবার জন্য রেখে দিলেন এবং ভিক্ষান্নের জন্য গ্রামে গেলেন। ভিক্ষান্তে কুটীরে ফিরে এসে দেখলেন, ইঁদুর আবার তাঁর কৌপীন টুকরো টুকরো ক'রে কেটে ফেলেছে। তিনি তাই দেখে মনে মনে বড় বিরক্ত হলেন এবং ভাবতে লাগলেন, "আবার কোথায় কার কাছে কৌপীন ভিক্ষা করব?" পরদিন আবার ভিক্ষায় বেরিয়ে গ্রামবাসীদের কাছে ইঁদুরের উপদ্রবের কথা জানালেন। গ্রামবাসীরা সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বল্লে, "আপনাকে রোজ রোজ কে কৌপীন দেবে? আপনি এক কাজ করুন - একটা বেড়াল পুষুন, তাহলে আর বেড়ালের ভয়ে ইঁদুর আসবে না।" সাধু তৎক্ষণাৎ গ্রাম থেকে একটা বেড়ালের বাচ্চা নিয়ে এলেন। সেই দিন থেকেই বেড়ালের ভয়ে ইঁদুরের উপদ্রব বন্ধ হল। তা দেখে সাধুর আনন্দের সীমা রইল না। ক্রমে সাধু সেই বেড়ালটাকে বেশ আদর-যত্নে লালন-পালন করতে লাগলেন এবং গ্রামে গিয়ে বেড়ালের জন্য দুধ ভিক্ষা ক'রে এনে খাওয়াতে লাগলেন। কিছুদিন পর কোন ব্যক্তি তাঁকে বললে, "সাধুজী, আপনার রোজ দুধের দরকার; দু-চার দিন ভিক্ষা ক'রে চলতে পারে। বার মাস কে আপনাকে দুধ দেবে? আপনি এক কাজ করুন, একটি গরু পুষুন, তা হলে তার দুধ খেয়ে আপনি নিজেও পরিতৃপ্ত হবেন, বেড়ালকেও খাওয়াতে পারবেন।" অল্পদিনের মধ্যেই সাধু একটি দুগ্ধবতী গাভী সংগ্রহ ক'রে নিয়ে এলেন, সাধুকে আর দুধের জন্য ভিক্ষা করতে হল না।

ক্রমে সাধু সেই গরুর খড়-বিচিলী ইত্যাদির জন্য গ্রামে ভিক্ষা করতে লাগলেন। তখন গ্রামের লোকেরা তাঁকে বলতে লাগল, "আপনার কুটীরের নিকট পতিত জমিতে চাষ বাস করুন, তা হলে আর খড়-বিচিলীর জন্য ভিক্ষা করতে হবে না।" তখন সাধু সকলের পরামর্শে নিকটস্থ পতিত জমিতে চাষ আরম্ভ করলেন। চাষের জন্য তাঁকে ক্রমে লোক ইত্যাদি নিযুক্ত করতে হল। যখন শস্যাদি সঞ্চিত হতে লাগল, তা রাখবার জন্য গোলাবাড়ি ইত্যাদি প্রস্তুত ক'রে তিনি ঠিক গৃহস্থের মতো মহাব্যস্ত হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। কিছুদিন পরে সাধুটির গুরু এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি ঐ সকল বিষয়-বৈভব দেখে একটি চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, "এইখানে একটি ত্যাগী কুটীরমধ্যে থাকতেন, তিনি কোথায় গেছেন বলতে পার?" চাকরটি কোন উত্তর দিতে পারলে না। পরে তিনিই ঐ সাধুর বাড়ির মধ্যে ঢুকে সামনে তাঁর শিষ্যকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "বৎস, এসব কি?" শিষ্য অপ্রতিভ হয়ে অমনি গুরুর পায়ে পড়ল এবং বলতে লাগল, "প্রভুজী, এসব এক কৌপীনকা ওয়াস্তে।" সাধুটি একে একে সব বৃত্তান্ত গুরুর নিকট বলতে লাগলেন। গুরুর দর্শনে তাঁর সকল আসক্তি কেটে গেল ও তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সব বিষয়-সম্পত্তি পরিত্যাগ ক'রে গুরুর পশ্চাদ্গামী হলেন।

৩০। হৃদয় মুখুজ্যে একদিন ঠাকুরকে বলেছিলেন, "মামা, তোমার প্রতি মার যখন এত দয়া, তুমি মার কাছ থেকে কিছু সিদ্ধাই চেয়ে নাও না কেন?" ঠাকুরের তখন বালকের ন্যায় অবস্থা। হৃদুর এই কথা শুনে তিনি একদিন চাঁপাতলার পুষ্করিণীর ঘাটে বসে বালকের ন্যায় মাকে বলতে লাগলেন, "মা হৃদু বলে, তুমি মার কাছ থেকে সিদ্ধাই চেয়ে নাও না কেন?" এই বলে তিনি মাকে চিন্তা করতে লাগলেন। অল্পক্ষণ পরেই তিনি সম্মুখে দেখলেন, একটি কালপেড়ে কাপড় পরা মোটা স্ত্রীলোক শৌচে বসেছে। তার পরক্ষণেই চলে এসে হৃদয়কে বললেন, "শ্যালা, তুই আমাকে কি বুদ্ধি দিয়েছিস্? আমি আর তোর কোন বুদ্ধিই নেব না। তোর কথা শুনে মাকে যেমন বললুম, 'মা, হৃদু আমাকে বলে, তুমি মার কাছ থেকে সিদ্ধাই চেয়ে নাও না কেন?' মা তৎক্ষণাৎ আমাকে ঐরূপ দেখিয়ে দিলেন।"

সাধনে সহায়

১। প্রথম অবস্থায় একটু নির্জনে বসে মন স্থির করতে হয়। তা না হলে অনেক দেখে শুনে মন চঞ্চল হয়। যেমন দুধে জলে এক সঙ্গে রাখলে মিশে যায়, কিন্তু দুধকে মন্থন ক'রে মাখন করতে পারলে জলের সঙ্গে মেশে না, সে জলের ওপর ভাসে; তেমনি যাদের মন স্থির হয়েছে, তারা যেখানে সেখানে বসে সর্বদা ভগবানকে চিন্তা করতে পারে।

২। নিষ্ঠা ভক্তি না হলে সচ্চিদানন্দলাভ হয় না। যেমন এক পতিতে নিষ্ঠা থাকলে সতী হয়, তেমনি আপনার ইষ্টের প্রতি নিষ্ঠা হলে ইষ্টদর্শন হয়।

৩। হনুমানকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, "আজ কি তিথি?" হনুমান বললে, "আমি বার, তিথি, নক্ষত্র ও-সব কিছু জানি না। আমি কেবল এক রাম-পাদপদ্ম জানি।"

৪। ধ্যান করবে মনে, বনে আর কোণে।

৫। নির্জনে না গেলে শক্ত রোগ সারবে কেমন ক'রে? রোগটি হয়েছে বিকার, আর যে ঘরে বিকার-রোগী সেই ঘরেই তেঁতুলের আচার ও জলের জালা। মেয়েমানুষ পুরুষের পক্ষে তেঁতুলের আচার, আর ভোগ-বাসনা জলের জালা। তাতে কি রোগ সারে? দিনকতক ঠাঁইনাড়া হয়ে নির্জনে গিয়ে সাধন-ভজন করতে হয়। তার পর নীরোগ হয়ে আবার সেই ঘরে থাকলে আর ভয় নেই।

৬। প্রথম অবস্থায় একটু নির্জনে বসে ধ্যান অভ্যাস করতে হয়। তার পর যখন ঠিক অভ্যাস হয়, তখন যেখানে সেখানে ধ্যান করতে পার। যেমন গাছ, যখন ছোট থাকে তখন তাকে যত্ন ক'রে বেড়া দিয়ে রাখতে হয়, তা না হলে গরু-ছাগলে খেয়ে নষ্ট ক'রে ফেলে। পরে যখন গুঁড়ি মোটা হয় তাতে দশটা গরু-ছাগল বাঁধলেও কিছুই করতে পারে না।

৭। একদিন একটি ছোকরা ভক্ত পরমহংসদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "ঠাকুর, কাম কি ক'রে দমন করা যায়?" ঠাকুর একটু হেসে বললেন, "সব স্ত্রীলোককে মাতৃবৎ দেখবি, আর স্ত্রীলোকের মুখের দিকে কখনও চাইবিনি, সর্বদা পায়ের দিকে চাইবি, তাহলেই সকল দুশ্চিন্তা দূরে পালিয়ে যাবে।"

৮। সহ্যগুণের চেয়ে আর গুণ নেই। যে সয়, সে-ই রয়। যে না সয়, সে নাশ হয়। সকল বর্ণের মধ্যে 'স' তিনটে - শ, ষ, স।

৯। সহ্যগুণের চেয়ে আর গুণ নেই। সকলেরই সহ্যগুণ থাকা চাই। যেমন কামার-বাড়ির নাইয়ের ওপর কত জোর ক'রে বড় বড় হাতুড়ি পেটে, তথাপি কিছুমাত্র বিচলিত হয় না; সেইরূপ কূটস্থবৎ বুদ্ধি থাকা চাই; যে যাই বলুক ও যে যাই করুক না কেন, সমুদয় সহ্য ক'রে লবে।

১০। মাছ যত দূরে থাক না, ভাল ভাল চার ফেলবামাত্র যেমন তারা ছুটে আসে, ভগবান হরিও সেইরূপ বিশ্বাসী ভক্তের হৃদয়ে শীঘ্র এসে উদিত হন।

১১। এক রকম বাদলেপোকা আছে, তারা আলো দেখলে ছুটে যায়, তারা তাতে প্রাণ দেয়, তবু অন্ধকারে আর যায় না; তেমনি যারা ভগবানের ভক্ত, তারা যেখানে সাধু থাকে ও ঈশ্বরীয় কথা হয়, সেখানে ছুটে যায়, সাধন-ভজন ছাড়া সংসারের অসার পদার্থে আর বদ্ধ হয় না।

১২। পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঈশ্বরলাভের খেই কোথায়? মহাদেব বললেন, বিশ্বাসই এর খেই। গুরুবাক্যে অচল ও অটল বিশ্বাস ব্যতীত সচ্চিদানন্দ-লাভ করা যায় না।

১৩। এই দুর্লভ মনুষ্যদেহ ধারণ ক'রে যে সচ্চিদানন্দকে লাভ করতে না পারে তার জন্মগ্রহণ করাই বৃথা।

১৪। মন কেমন জান? যেমন স্প্রিং-এর গদি। যতক্ষণ গদির উপরে বসে থাকা যায় ততক্ষণই নীচু হয়ে থাকে, আর ছেড়ে দিলেই তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ে। তেমনি সৎ ও সাধুসঙ্গে ভগবানের ভাব যা কিছু লাভ করে, আবার সাধুসঙ্গ পরিত্যাগ করবামাত্র যে-কে-সেই - আপনার পূর্বভাব ধারণ করে।

১৫। নামেতে রুচি ও বিশ্বাস করতে পারলে তার আর কোন প্রকার বিচার বা সাধন করতে হয় না। নামের প্রভাবে সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়; নামেতেই চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং নামেতেই সচ্চিদানন্দ-লাভ হয়ে থাকে।

১৬। সরল বিশ্বাস ও অকপটতা থাকলে ভগবানলাভ হয়। একটি লোকের একটি সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লোকটি সাধুকে বিনীতভাবে উপদেশ জিজ্ঞাসা করলে। সাধুটি বললেন, "ভগবানকে প্রাণ-মন দিয়ে ভালবাস।" লোকটি বললে, "ভগবানকে কখনও দেখিনি, তাঁর বিষয় কিছুই জানিনি, কি ক'রে তাঁকে ভালবাসব?" সাধুটি জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কাকে ভালবাস?" লোকটি বললে, "আমার কেউ নেই। শুধু একটি মেড়া আছে, ঐটিকেই ভালবাসি।" সাধুটি বললেন, "তবে, ঐ মেড়ার ভেতর নারায়ণ আছে জেনে প্রাণ-মন দিয়ে সেবা করবে ও ভালবাসবে।" এই বলেই সাধুটি চলে গেলেন। লোকটিও ঐ মেড়ার ভেতর নারায়ণ আছেন বিশ্বাস ক'রে তার প্রাণপণ সেবা করতে আরম্ভ করলে। সাধুটি বহুদিন পরে সে রাস্তায় ফিরে যাবার সময় লোকটির সন্ধান ক'রে জিজ্ঞাসা করলেন, "এখন কেমন আছ?" লোকটি প্রণাম ক'রে বললে, "গুরো, আপনার কৃপায় বেশ আছি; আপনি যেমন বলেছিলেন, সেইরূপ ভাবনা ক'রে আমার খুব উপকার হয়েছে। মেড়ার ভিতরে মধ্যে মধ্যে এক অপরূপ মূর্তি দেখতে পাই - তাঁর চার হাত। তাঁকে দর্শন ক'রে আমি বেশ পরমানন্দেই আছি।"

১৭। সাধুসঙ্গ কেমন জান? - যেমন চালধোয়ানি জল। যার অত্যন্ত নেশা হয়েছে তাকে যদি চালের জল খাওয়ানো যায় তা হলে তার নেশা কেটে যায়। সেইরূপ এই সংসার-মদে যারা মত্ত হয়েছে, তাদের নেশা কাটাবার - একমাত্র উপায় সাধুসঙ্গ।

১৮। ঠাকুর সাপ এবং সাধুর কথা বলতেন। সাপ যেমন নিজে গর্ত না ক'রে ইঁদুরের গর্তে বাস করে, সাধুও তেমনি নিজের জন্য বাড়ি প্রস্তুত করে না, আবশ্যক হলে অন্য লোকের বাড়িতে বাস ক'রে থাকে।

১৯। যেমন উকিল দেখলে মামলা ও কাছারির কথা মনে আসে, আর ডাক্তার-কবিরাজ দেখলে রোগ ও ঔষধের কথা মনে পড়ে, তেমনি সাধু ও ভক্ত দেখলে ভগবানের ভাব-উদ্দীপন হয়।

সাধনে অধ্যবসায়

১। রত্নাকরে অনেক রত্ন আছে; তুমি এক ডুবে পেলে না বলে রত্নাকরকে রত্নহীন মনে করো না। সেইরূপ একটু সাধনা ক'রে ঈশ্বরদর্শন হল না বলে হতাশ হয়ো না। ধৈর্য ধরে সাধন করতে থাক, যথাসময়ে ঈশ্বরের কৃপা তোমার ওপর হবে।

২। সমুদ্রে একরকম ঝিনুক আছে, তারা সদা-সর্বদা হাঁ ক'রে জলের ওপর ভাসে, কিন্তু স্বাতী নক্ষত্রের এক ফোঁটা জল তাদের মুখে পড়লে তারা মুখ বন্ধ ক'রে একেবারে জলের নিচে চলে যায়। আর ওপরে আসে না। তত্ত্বপিপাসু বিশ্বাসী সাধকও সেইরকম গুরুমন্ত্ররূপ এক ফোঁটা জল পেয়ে সাধনের অগাধ জলে একেবারে ডুবে যায়, আর অন্য দিকে চেয়ে দেখে না।

৩। যেমন কোন ধনী লোকের কাছে যেতে হলে সেপাই-সান্ত্রীকে অনেক খোসামোদ করতে হয়, তেমনি ঈশ্বরের কাছে যেতে হলে অনেক সাধন-ভজন ও সৎসঙ্গ আদি নানা উপায়ের দ্বারা যেতে হয়।

৪। এক কাঠুরে বন থেকে কাঠ এনে কোন রকমে দুঃখে কষ্টে দিন কাটাত। একদিন জঙ্গল থেকে সরু সরু কাঠ কেটে মাথায় ক'রে আনছে, হঠাৎ একজন লোক সেই পথ দিয়ে যেতে যেতে তাকে ডেকে বললে, "বাপু এগিয়ে যাও।" পরদিন কাঠুরে সেই লোকের কথা শুনে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে মোটা মোটা কাঠের জঙ্গল দেখতে পেলে; সেদিন যতদূর পারলে কেটে এনে বাজারে বেচে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশী পয়সা পেলে। পরদিন আবার সে মনে মনে ভাবতে লাগল, তিনি আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন; ভাল, আজ আর একটু এগিয়ে দেখি না কেন। সে এগিয়ে গিয়ে চন্দন কাঠের বন দেখতে পেলে। সেই চন্দন কাঠ মাথায় ক'রে নিয়ে বাজারে বেচে অনেক বেশী টাকা পেলে। পরদিন আবার মনে করলে, আমায় এগিয়ে যেতে বলেছেন। সে সেদিন আরও খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে তামার খনি দেখতে পেলে। সে তাতেও না ভুলে দিন দিন আরও যত এগিয়ে যেতে লাগল - ক্রমে ক্রমে রূপা, সোনা, হীরার খনি পেয়ে মহা ধনী হয়ে পড়ল। ধর্মপথেরও ঐরূপ। কেবল এগিয়ে যাও। একটু আধটু রূপ, জ্যোতি দেখে বা সিদ্ধাই লাভ ক'রে আহ্লাদে মনে করো না যে, আমার সব হয়ে গেছে।

৫। যে মাছ ধরতে ভালবাসে, সে যদি শোনে যে অমুক পুকুরে বড় বড় মাছ আছে, সে কি করে? যারা সেই পুকুরে মাছ ধরেছে, সে যদি তাদের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা ক'রে বেড়ায় - সত্যি সত্যি সে পুকুরে বড় বড় মাছ আছে কিনা, যদি থাকে তবে কিসের চার ফেলতে হয়, কি টোপ খায় - এ-সব বিষয় ভাল ক'রে জেনে নিয়ে যদি তাকে মাছ ধরতে যেতে হয়, তাহলে তার মাছ তো একেবারেই ধরা হয় না। সেখানে গিয়ে ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরে বসে থাকতে হয়, তারপর সে মাছের ঘাই ও ফুট দেখতে পায় এবং তারপর সে মাছ ধরতে পারে। ধর্মরাজ্যেরও সেইরূপ; সাধক ও মহাজনদের কথায় বিশ্বাস ক'রে, ভক্তি-চার ছড়িয়ে, ধৈর্যরূপ ছিপ ফেলে বসে থাকতে হয়।

৬। একটি লোক পরমহংসদেবের নিকট এসে বললে, "মহাশয়, অনেকদিন সাধন-ভজন করলুম, কিছুই তো বুঝতে সুঝতে পারলুম না, আমাদের সাধন-ভজন করা মিছে।" পরমহংসদেব ঈষৎ হাস্য ক'রে বললেন, "দেখ, যারা খানদানী চাষা, তারা বার বৎসর অনাবৃষ্টি হলেও চাষ দিতে ছাড়ে না; আর যারা ঠিক চাষা নয়, চাষের কাজে বড় লাভ শুনে কারবার করতে আসে, তারাই এক বৎসর বৃষ্টি না হলে চাষ ছেড়ে দিয়ে পালায়; তেমনি যারা ঠিক ঠিক ভক্ত ও বিশ্বাসী, তারা সমস্ত জীবন তাঁর দর্শন না পেলেও তাঁর নাম-গুণকীর্তন করতে ছাড়ে না।"

৭। যেমন সাঁতার দিতে হলে আগে অনেক দিন ধরে জলে হাত-পা ছুঁড়তে হয়, একবারেই সাঁতার দেওয়া যায় না; সেইরূপ ব্রহ্মরূপ সমুদ্রে সাঁতার দিতে গেলে অনেকবার উঠতে পড়তে হয়, একবারে হয় না।

ব্যাকুলতা

১। তাঁর প্রতি কিরূপ মন চাই? যেমন সতীর পতিতে, কৃপণের ধনেতে, বিষয়ীর বিষয়েতে - এইরূপ টান যখন ভগবানের প্রতি হয়, তখন ভগবানলাভ হয়।

২। মার পাঁচটি ছেলে আছে। তিনি কাকেও খেলনা, কাকেও পুতুল, কাকেও বা খাবার দিয়ে ভুলিয়ে রেখে দিয়েছেন। তার মধ্যে যে ছেলেটি খেলনা ফেলে দিয়ে 'মা কোথা' বলে কাঁদে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঠাণ্ডা করেন। হে জীব! তুমি কাম-কাঞ্চন নিয়ে ভুলে আছ। এসব ফেলে দিয়ে যখন ঈশ্বরের জন্য কাঁদবে, তখন তিনি এসে তোমায় কোলে ক'রে নেবেন।

৩। বিষয়লাভ হল না, ছেলে হল না বলে লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, কিন্তু ভগবানলাভ হল না, ভগবানের পাদপদ্মে ভক্তি হল না বলে এক ফোঁটা চোখের জল কজন লোকে ফেলে?

৪। ঋষিকৃষ্ণ (যীশুখ্রীষ্ট) একদিন সমুদ্রের ধারে বেড়াচ্ছিলেন। একটি ভক্ত এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে, "প্রভো, কি করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়?" তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে জলের ভেতর নিয়ে ডুবিয়ে রাখলেন। খানিকক্ষণ পরে হাত ধরে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার কিরূপ অবস্থা হচ্ছিল?" ভক্তটি উত্তরে বললেন, "প্রাণ যায় যায় - আটুপাটু কচ্ছিল।" প্রভু যীশু তখন তাকে বললেন, "যখন তোমার ভগবানের জন্য প্রাণ এমনি আটুপাটু করবে তখন তাঁর দর্শনলাভ হবে।"

৫। ছেলে যেমন পয়সার জন্য মার কাছে আব্দার করে, কখনও কাঁদে, কখনও মারে, সেইরূপ আনন্দময়ী মাকে আপনার হতে আপনার জেনে তাঁকে দেখবার জন্য যিনি সরল শিশুর ন্যায় ব্যাকুল হয়ে ক্রন্দন করেন, তাঁকে সচ্চিদানন্দময়ী মা দেখা না দিয়ে থাকতে পারেন না।

৬। ভগবানলাভের জন্য ব্যাকুলতার কথায় পরমহংসদেব বলতেন, "যখন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরবাড়িতে সন্ধ্যা-আরতির কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠত তখন আমি গঙ্গার ধারে গিয়ে মাকে কেঁদে কেঁদে চিৎকার ক'রে বলতুম, 'মা, দিন তো গেল, কই এখনও তোমার দেখা পেলুম না।'"

৭। যার তৃষ্ণা পায়, সে কি গঙ্গার জল ঘোলা বলে তখনি একটি পুকুর কেটে জল পান করতে যায়? তেমনি যার ধর্মতৃষ্ণা পায়নি, সে এ-ধর্ম ঠিক নয়, ও-ধর্ম ঠিক নয় - এইরূপ বলে গোলমাল ক'রে বেড়ায়। তৃষ্ণা থাকলে অত বিচার করা চলে না।

ভক্তি ও ভাব

১। হীরে মতি বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকার পাওয়া যায়, কিন্তু কৃষ্ণে মতি কটা মেলে।

২। সাদা কাঁচের ওপর কোন বস্তুর দাগ পড়ে না, কিন্তু তাতে যদি মশলা মাখান থাকে তবেই দাগ পড়ে, যেমন ফটোগ্রাফ; তেমনি শুদ্ধ মনে যদি ভক্তি-মশলা লাগান থাকে, তা হলে ভগবানের রূপ প্রত্যক্ষ হয়। কেবলমাত্র শুদ্ধ মনে ভক্তি ব্যতীত রূপ দেখা যায় না।

৩। প্রেম কাকে বলে জান? যখন হরি বলতে বলতে জগৎ তো ভুল হয়ে যাবেই, এমন যে নিজের দেহ এত প্রিয় জিনিস, তার ওপর পর্যন্ত সংজ্ঞা থাকবে না।

৪। আগে ভাব তারপর প্রেম, শেষে ভাব-সমাধি; যেমন সঙ্কীর্তন করতে করতে প্রথমে বলে, "নিতাই আমার মাতা হাতী - নিতাই আমার মাতা হাতী"; ক্রমে ভাবে মগ্ন হয়ে শুধু বলে, "হাতী, হাতী"। তারপর কেবল "হাতী" এই কথাটি মুখে থাকে। শেষে কেবল "হা" বলতে বলতে ভাব-সমাধিতে মগ্ন হয়ে যায়। এইরূপে যে ব্যক্তি এতক্ষণ কীর্তন কচ্ছিল, সে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে চুপ হয়ে যায়।

৫। যেমন কুঁড়ে ঘরে হাতী প্রবেশ করলে ঘরকে তোলপাড় ক'রে ফেলে, সেই রকম ভাব-রূপ হস্তী দেহ-ঘরে প্রবেশ করলে দেহকে তোলপাড় করে ফেলে।

৬। যার ভগবানে ভক্তিলাভ হয়েছে, তার কিরূপ ভাব হয় জান? আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর, তুমি ঘরণী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন বলাও তেমনি বলি, যেমন করাও তেমনি করি, যেমন চালাও তেমনি চলি।

৭। ভগবানের পাদপদ্মে ভক্তি হলেই বিষয়-কর্ম আপনা আপনি ত্যাগ হয়ে আসে। তার আর বিষয়-কর্ম ভাল লাগে না। যেমন ওলা মিছরির পানা খেলে চিটেগুড়ের পানা আর কেউ খেতে চায় না।

৮। সন্ধ্যা-আহ্নিক ততদিন দরকার যতদিন না তাঁর পাদপদ্মে ভক্তিপ্রেম হয় ও তাঁর নাম করতে করতে চক্ষে জল পড়ে, আর শরীরে রোমাঞ্চ হয়।

৯। যাত্রার দল দেখেছ, যতক্ষণ বাজনা খচ্ মচ্ করতে থাকে, "কৃষ্ণ এস হে, কৃষ্ণ এস হে" বলে চিৎকার ক'রে গান করচে, কৃষ্ণের তখনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে আপন মনে সাজ পরে তামাক খাচ্ছে, গল্প করচে। যখন সে-সকল থামল, নারদ ঋষি মৃদুস্বরে প্রেমভরে গান ধরলেন, "হরি প্রাণ হে গোবিন্দ, মম জীবন", তখন কৃষ্ণ আর থাকতে পারলেন না। অমনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি আসরে নেমে পড়লেন। সাধকের ভেতরেও সেইরূপ। যতক্ষণ সাধক, "প্রভো এস হে, প্রভো এস হে" বলে চেঁচাচ্চে, ততক্ষণ জেনো, প্রভু সেখানে আসেননি। প্রভু যখন আসবেন, সাধক তখন ভাবে গদগদ হবেন, আর চেঁচাবেন না। সাধক যখন ভাবে গদগদ হয়ে ডাকে, তখন প্রভু আর দেরি করতে পারেন না।

১০। অহল্যা বলেছিলেন, "হে রাম, যদি শূকরযোনিতেও জন্ম হয়, সেও স্বীকার; কিন্তু যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে আমার অচলা শ্রদ্ধা-ভক্তি থাকে, আর আমি কিছুই চাই না।"

ধ্যান

১। সত্ত্বগুণীর ধ্যান কিরূপ জান? তারা রাত্রে মশারি খাটিয়ে তার ভেতরে বসে ধ্যান করে। লোকে মনে করে, সে ঘুমুচ্ছে। তাদের বাহ্যিক লোক-দেখান ভাব একেবারে নেই।

২। (সাধকের) ধ্যানের সময় মধ্যে মধ্যে একপ্রকার নিদ্রার মতন আসে, তাকে যোগনিদ্রা বলে। সে অবস্থায় অনেক সাধক ভগবানের রূপ-দর্শন পায়।

৩। ধ্যান এমন করবে যে তাতে একেবারে তন্ময় হয়ে যাবে - ডাইলিউট (dilute) হয়ে যাবে; যখন ঠিক ধ্যান হয়, পাখীরা তার গায়ে বসে, কিন্তু সে টের পায় না। মা-কালীর মন্দিরের নাটমন্দিরে আমি যখন বসে ধ্যান করতুম, তখন সেখানকার লোকেরা বলতো, "আপনার গায়ে চড়াই ও শালিক পাখী বসে খেলা করে।"

সাধন ও আহার

১। যে হবিষ্যান্ন ভক্ষণ করে, কিন্তু ঈশ্বরলাভ করতে চায় না, তার হবিষ্যান্ন গোমাংসতুল্য হয়। আর যে গোমাংস ভক্ষণ করে কিন্তু ভগবানকে লাভ করবার চেষ্টা করে, তার পক্ষে গোমাংস হবিষ্যান্নের তুল্য হয়।

২। স্বর্গীয় মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয়ের শাশুড়ি একদিন পরমহংসদেবকে দর্শন করতে এসেছিলেন। ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, "তোমরা বেশ আছ, সংসারে থেকে ভগবানেতে মন রেখেছ।" তিনি বললেন, "কই, আমাদের আর কিছুই হল না; এখনও আমি যার-তার এঁটো খেতে পারি না।" ঠাকুর বললেন, "সে কি গো? যার তার এঁটো খেলেই কি সব হল? কুকুর, শেয়াল সবারই এঁটো খায়, তা বলেই কি তাদের ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়েছে?"

ভগবৎ-কৃপা

১। হাজার বছরের অন্ধকার ঘর যেমন একবার একটা দেশলাইয়ের কাটি জ্বাললে তখনি আলো হয়, তেমনি জীবের জন্ম-জন্মান্তরের পাপও তাঁর একবার কৃপাদৃষ্টিতে দূর হয়।

২। মলয়ের হাওয়া লাগলে যেসব গাছের সার আছে, সেই সব গাছে চন্দন হয়, কিন্তু অসার - যেমন বাঁশ, কলা ইত্যাদি গাছে কিছু হয় না। ভগবৎ-কৃপা পেলে যাঁদের সার আছে, তাঁরাই মুহূর্তের মধ্যে মহা সাধুভাবে পূর্ণ হন, কিন্তু বিষয়াসক্ত অসার মানুষের সহজে কিছু হয় না।

৩। ছোট ছোট ছেলেরা একলা ঘরের ভেতরে বসে আপনমনে পুতুল খেলে, কোন ভয়-ভাবনা নেই। কিন্তু যেই মা এল, অমনি সকলে পুতুল ফেলে 'মা' 'মা' বলে কাছে দৌড়ে গেল। তোমরাও এখন ধন-মান-যশের পুতুল লয়ে সংসারে নিশ্চিন্ত হয়ে সুখে খেলা করছ, কোন ভয়-ভাবনা নেই। যদি মা আনন্দময়ীকে তোমরা একবার দেখতে পাও, তা হলে আর তোমাদের ধন-মান-যশ ভাল লাগবে না, সব ফেলে তাঁর কাছে দৌড়ে যাবে।

৪। কাদা ঘাঁটাই ছেলেদের স্বভাবসিদ্ধ; কিন্তু মা-বাপ তাদের অপরিষ্কার থাকতে দেন না; সেরূপ জীব এই মায়ার সংসারে পড়ে যতই মলিন হোক না কেন, ভগবান্ তাদের শুদ্ধ হবার উপায় করে দেন।

সিদ্ধ অবস্থা

১। লোহা যদি একবার স্পর্শমণি ছুঁয়ে সোনা হয়, তাকে মাটির ভেতর চাপা রাখ আর আস্তাকুঁড়ে ফেলে রাখ, সে সোনা। যিনি সচ্চিদানন্দ লাভ করেছেন, তাঁর অবস্থাও সেই রকম। তিনি সংসারেই থাকুন, আর বনেই থাকুন, তাতে তাঁর দোষস্পর্শ হয় না।

২। যেমন লোহার তলোয়ার স্পর্শমণি ছোঁয়ালে সোনার তলোয়ার হয়, আকার-প্রকার সেই রকমই থাকে, কিন্তু তাতে আর হিংসার কাজ চলে না; সেই রকম ভগবানের পাদপদ্ম স্পর্শ করলে তার দ্বারা আর কোন অন্যায় কাজ হয় না।

৩। কোন ব্যক্তি পরমহংসদেবের নিকট জিজ্ঞাসা করলেন - সিদ্ধপুরুষ হলে কিরূপ অবস্থা হয়? উত্তরে তিনি বললেন - যেমন আলু-বেগুন সিদ্ধ হলে নরম হয়, তেমনি সিদ্ধপুরুষের স্বভাব নরম হয়ে থাকে। তাঁর সব অভিমান চলে যায়।

৪। পরমহংসদেব নিজের শরীরের দিকে দেখিয়ে বলতেন, "এ একটা খোলমাত্র, মা ব্রহ্মময়ী একে আশ্রয় ক'রে খেলছেন।"

৫। রামপ্রসাদী গান যখনই শোন, তখনই নূতন বলে বোধ হয়। তার কারণ জান? রামপ্রসাদ যখন গান বাঁধতেন, মা ব্রহ্মময়ী তাঁর হৃদয়মধ্যে বিরাজ করতেন।

৬। সংসারে অনেক প্রকারে সিদ্ধ অবস্থা লাভ হয়, যেমন - স্বপ্ন-সিদ্ধ, মন্ত্র-সিদ্ধ, হঠাৎ-সিদ্ধ ও নিত্য-সিদ্ধ।

৭। স্বপ্নেতে কেহ কেহ ইষ্টমন্ত্র পেয়ে তাই জপ ক'রে সিদ্ধ হয়। মন্ত্র-সিদ্ধ - সদ্গুরুর নিকট মন্ত্রগ্রহণ ক'রে সাধনার দ্বারা সিদ্ধ হয়। হঠাৎ-সিদ্ধ - দৈবযোগে কোন মহাপুরুষের কৃপালাভ ক'রে যে সিদ্ধ হয়, তাকে হঠাৎ-সিদ্ধ বলে। নিত্য-সিদ্ধ - তাদের বালককাল থেকেই ধর্মে মতি থাকে। যেমন লাউ, কুমড়ো গাছে আগে ফল হয়, পরে ফুল ফোটে।

৮। সাঁকোর নিচে জল সহজে বেরিয়ে যায়, জমে না; তেমনি মুক্ত পুরুষদিগের হাতে যে টাকা-পয়সা আসে তা থাকে না, অমনি খরচ হয়ে যায়। তাঁদের বিষয়-বুদ্ধি একেবারেই নেই।

৯। "ধ্যান-সিদ্ধ যেই জন, মুক্তি তার ঠাঁই।" ধ্যান-সিদ্ধ কাদের বলে জান? যাঁরা ধ্যান করতে বসলেই ভগবানের ভাবে বিভোর হয়ে যায়।

১০। মুক্ত পুরুষ সংসারে কি রকম থাকেন জান? যেমন পানকৌড়ি জলে থাকে, কিন্তু তাদের গায়ে জল লাগে না; যদিও গায়ে একটু জল লাগে, তা হলে একবার গা ঝেড়ে ফেললে তখনই সব চলে যায়।

১১। জাহাজ যে দিকে যাক্ না কেন কম্পাসের কাঁটা উত্তর দিকেই থাকে, তাই জাহাজের দিক ভুল হয় না; মানুষের মন যদি ঈশ্বরের দিকে থাকে, তা হলে আর তার কোন ভয় থাকে না।

১২। চকমকি পাথর শত বৎসর জলের ভেতর পড়ে থাকলেও তার আগুন নষ্ট হয় না, তুলে লোহার ঘা মারবামাত্রই আগুন বেরোয়। ঠিক বিশ্বাসী ভক্ত হাজার হাজার কুসঙ্গের মধ্যে পড়ে থাকলেও তার বিশ্বাস-ভক্তি কিছুতেই নষ্ট হয় না, ভগবৎ-কথা হলে তখনি আবার সে ঈশ্বর-প্রেমে উন্মত্ত হয়।

১৩। যে যেরূপ ভাবনা ক'রে থাকে, তার সিদ্ধিও সেইরকম হয়ে থাকে। যেমন দৃষ্টান্ততে বলে, আরসোলা কাঁচপোকাকে ভেবে ভেবে কাঁচপোকা হয়ে যায়। তেমনি যে সচ্চিদানন্দকে ভাবনা করে, সেও আনন্দময় হয়ে যায়।

১৪। মাতালেরা যেমন নেশার ঝোঁকে পরনের কাপড় কখনও মাথায় বাঁধে এবং কখনও বগলে নিয়ে বেড়ায়, তেমনি সিদ্ধ মহাপুরুষদেরও বাহ্য অবস্থা প্রায় সেইরূপই হয়ে থাকে।

১৫। অহঙ্কার কি রকম জান? যেমন পদ্মের পাঁপড়ি ও নারকেল সুপারির বালতো, খসে গেলেও সেস্থানে একটা দাগ থাকে; তেমনি অহঙ্কার গেলে তাতে একটু দাগের চিহ্ন থাকেই থাকে। তবে সে অহঙ্কারে কারও কিছু অনিষ্ট করতে পারে না। তার দ্বারা খাওয়া-দাওয়া, শোয়া ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোন কর্ম চলে না।

১৬। যেমন আম পাকলে বোঁটা থেকে আপনি খসে পড়ে, তেমনি জ্ঞানলাভ হলে আত্মাভিমান প্রভৃতি আপনি চলে যায়। জোর ক'রে জাতি ত্যাগ করা ঠিক নয়।

১৭। গুণ তিন রকমের - সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। এই তিন গুণের কেউ তাঁর নিকট পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না। যেমন একজন লোক বনের পথ দিয়ে চলে যাচ্ছিল, এমন সময় তিনজন ডাকাত এসে তাকে ধরলে ও তার যা-কিছু ছিল সর্বস্ব কেড়ে-কুড়ে নিলে; তার ভেতর একজন ডাকাত বললে, "এ লোকটাকে রেখে আর কি হবে?" এই কথা বলেই, খাঁড়া উঁচিয়ে তাকে কাটতে এল। আর একজন ডাকাত এসে বললে, "না হে, একে কেটো না, কেটে কি হবে? এর হাত-পা বেঁধে এইখানেই ফেলে রেখে যাও।" পরে সকলে মিলে তার হাত-পা বেঁধে সেখানে রেখে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে তাদের মধ্যে একজন ফিরে এসে বললে, "আহা, তোমার কত লেগেছে, এস আমি এখন তোমার বন্ধন খুলে দিই।" ডাকাতটি তখন বন্ধন খুলে দিয়ে বললে, "আমার সঙ্গে সঙ্গে এস তোমায় রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।" পরে রাস্তার নিকটবর্তী হয়ে বললে, "ঐ রাস্তা ধরে চলে গেলে তুমি বাড়ি পৌঁছুবে।" লোকটি তখন তাকে বলতে লাগল, "আপনি আমার প্রাণদান করলেন, আপনি আমার বাড়ি পর্যন্ত আসুন।" ডাকাত তখন বললে, "আমি সেখানে যেতে পারব না, লোকে টের পাবে - আমি কেবল তোমাকে রাস্তা দেখিয়ে চললুম।"

১৮। মুক্ত পুরুষ সংসারে কিরূপ অবস্থায় থাকে জান? যেমন ঝড়ের এঁটো পাতা। নিজের কোন ইচ্ছা বা অভিমান থাকে না। বাতাসে তাকে উড়িয়ে যে দিকে নিয়ে যায়, সেই দিকে যায় - কখনও বা আস্তাকুঁড়ে, কখনও বা ভাল জায়গায়।

১৯। পরমহংসদেব বলতেন, "গুরু, কর্তা, বাবা - এই তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। ঈশ্বর কর্তা, আমি অকর্তা, তিনি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র।"

২০। যতদিন শুধু ধান থাকে, পুঁতে দিলেই গাছ হয়। কিন্তু সেই ধানকে সিদ্ধ ক'রে পুঁতলে আর গাছ হয় না; তেমনি যাঁরা সিদ্ধ হয়েছেন, তাঁদের আর এ সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয় না।

২১। পরমহংস অবস্থা কাকে বলে জান? যেমন হাঁসকে দুধে-জলে এক সঙ্গে দিলে, দুধ খেয়ে জলটি ফেলে রাখে। তাঁরা তেমনি সংসারে সার যে সচ্চিদানন্দ, তাঁকে গ্রহণ করেন, আর অসার যে সংসার, তাকে ত্যাগ করেন।

২২। প্রথমতঃ অজ্ঞান, তার পরে জ্ঞান। পরিশেষে যখন সচ্চিদানন্দ লাভ হয়, তখন জ্ঞান ও অজ্ঞানের পারে চলে যায়। যেমন গায়ে কাঁটা ফুটলে বাইরে থেকে যত্ন ক'রে আর একটি কাঁটা এনে কাঁটাটিকে তুলে ফেলে তারপর দুটি কাঁটাই ফেলে দেয়।

২৩। যে ব্যক্তি সিদ্ধিলাভ করেছেন অর্থাৎ যাঁর ঈশ্বর-সাক্ষাৎকার হয়েছে, তাঁর দ্বারা আর কোনরূপ অন্যায় কার্য হতে পারে না; যেমন যে নাচতে জানে, তার পা কখনো বেতালে পড়ে না।

২৪। বৃহস্পতির পুত্র কচের সমাধিভঙ্গের পর যখন মন বহির্জগতে নেমে আসছিল, তখন ঋষিরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "এখন তোমার কিরূপ অনুভূতি হচ্ছে?" তাতে তিনি বলেছিলেন, "সর্বং ব্রহ্মময়ং - তিনি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।"

সর্বধর্ম-সমন্বয়

১। যেমন গ্যাসের আলো এক স্থান হতে এসে শহরে নানা স্থানে নানা ভাবে জ্বলছে, তেমনি নানা দেশের নানা জাতের ধার্মিক লোক সেই এক ভগবান্ হতে আসছে।

২। ছাতের উপর উঠতে হলে মই, বাঁশ, সিঁড়ি ইত্যাদি নানা উপায়ে যেমন ওঠা যায়, তেমনি এক ঈশ্বরের কাছে যাবার অনেক উপায় আছে। প্রত্যেক ধর্মই এক-একটি উপায়।

৩। ঈশ্বর এক, তাঁর অনন্ত নাম ও অনন্ত ভাব। যার যে নামে ও যে ভাবে ডাকতে ভাল লাগে, সে সেই নামে ও সেই ভাবে ডাকলে দেখা পায়।

৪। কোন ব্যক্তি যে ভাবে, যে নামে ও যে রূপেই হোক না কেন সেই এক অদ্বিতীয় সচ্চিদানন্দ-জ্ঞানে যদি সাধন-ভজন করে, তবে তার ভগবানলাভ নিশ্চয়ই হবে।

৫। যত মত, তত পথ। যেমন এই কালীবাড়িতে আসতে হলে কেউ নৌকায়, কেউ গাড়ীতে, কেউ বা হেঁটে আসে, সেইরূপ ভিন্ন ভিন্ন মতের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন লোকের সচ্চিদানন্দ লাভ হয়ে থাকে।

৬। মার ভালবাসা সব ছেলের প্রতি সমান, কিন্তু কোন ছেলের জন্য লুচি, কারও জন্য খই-বাতাসা প্রভৃতি যার যেমন আবশ্যক বোঝেন, সেই রকমেরই ব্যবস্থা ক'রে থাকেন। সেইরূপ ভগবানও বিভিন্ন সাধকের শক্তি ও অবস্থানুযায়ী সাধনের ব্যবস্থা করেন।

৭। মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেন ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, "ভগবান্ এক, তবে ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর এত বাদ-বিসংবাদ দেখা যায় কেন?" উত্তরে পরমহংসদেব বললেন, "যেমন এই পৃথিবীতে এটা আমার জমি ও এই আমার বাড়ি বলে ঘিরে বসে থাকে; কিন্তু ওপরে সেই এক অনন্ত আকাশ, সেখানে যেমন কেউ ঘিরতে পারে না, তেমনি মানুষ অজ্ঞানে আপনার আপনার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে বৃথা গোলমাল করে। যখন ঠিক ঠিক জ্ঞানলাভ হয়, তখন আর পরস্পরের মধ্যে বিবাদ থাকে না।"

৮। হিন্দুদের মধ্যে যখন নানা মতের কথা শুনতে পাওয়া যায়, তখন আমাদের পক্ষে কোন্ মত শ্রেয়? আমরা কোন্ মত গ্রহণ করব? পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "ঠাকুর, সচ্চিদানন্দরূপের খেই কোথায়?" মহাদেব বললেন, "বিশ্বাস।" মতে কিছু আসে যায় না। যিনি যে মন্ত্রে দীক্ষিত হন না কেন, বিশ্বাসের সহিত তিনি তারই সাধন করুন।

৯। যাদের সঙ্কীর্ণ ভাব, তারাই অন্যের ধর্মকে নিন্দা করে ও আপনার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে দল পাকায়; আর যারা ঈশ্বরানুরাগী - কেবল সাধন-ভজন করতে থাকে, তাদের ভেতর কোনরূপ দলাদলি থাকে না; যেমন পুষ্করিণী বা গেড়ে ডোবায় দল জন্মায়, নদীতে কখনও জন্মায় না।

১০। ভগবান্ এক, সাধক ও ভক্তেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ও রুচি অনুসারে তাঁর উপাসনা ক'রে থাকে। যেমন গৃহস্থেরা একটা বড় মাছ বাড়িতে এলে কেউ ঝোল করে, কেউ ভাজে, কেউ তেল-হলুদে চচ্চড়ি করে, কেউ ভাতে দিয়ে, কেউ কেউ বা অম্বল ক'রে খেয়ে থাকে। সেইরূপ যাদের যেমন রুচি, তারা সেই রকম ভাবে ভগবানের সাধন-ভজন-উপাসনা ক'রে থাকে।

১১। যেমন জল এক পদার্থ - দেশ, কাল, পাত্র-ভেদে তার ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়। বাঙ্গালা দেশে জল বলে, হিন্দিতে পানি বলে, ইংরাজীতে ওয়াটার বা একোয়া বলে। পরস্পরের ভাষা না জানা থাকলে কারুর কথা কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু জানলে আর ভাবের কোনরূপ ব্যতিক্রম হয় না।

১২। ভগবানের নাম ও চিন্তা যে রকম করেই কর না কেন, তাতেই কল্যাণ হবে। যেমন মিছরির রুটি সিধে করে খাও বা আড় করেই খাও খেলে মিষ্টি লাগবেই লাগবে।

কর্মফল

১। পাপ আর পারা কেউ হজম করতে পারে না। যদি কেউ লুকিয়ে পারা খায়, তা হলে কোন দিন না কোন দিন গায়ে ফুটে বেরোবে। পাপ করলেও তেমনি তার ফল একদিন না একদিন নিশ্চয় ভোগ করতে হবে।

২। গুটিপোকা যেমন আপনারই নালে ঘর ক'রে আপনি বদ্ধ হয়, তেমনি সংসারী জীব আপনার কর্মে আপনি বদ্ধ হয়। যখন প্রজাপতি হয়, তখন কিন্তু ঘর কেটে বেরোয়, তেমনি বিবেক-বৈরাগ্য হলে বদ্ধজীব মুক্ত হয়ে যায়।

যুগধর্ম

১। পরমহংসদেব সর্বদা বলতেন - "হাততালি দিয়ে সকালে ও সন্ধ্যাকালে হরিনাম করো, তা হলে সব পাপতাপ চলে যাবে। যেমন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিলে গাছের সব পাখী উড়ে যায়, তেমনি হাততালি দিয়ে হরিনাম করলে দেহ-গাছ থেকে সব অবিদ্যারূপ পাখী উড়ে পালায়।"

২। আগে সাদাসিধে জ্বর হোত, সামান্য পাঁচন ইত্যাদিতে সেরে যেত; এখন যেমন ম্যালেরিয়া জ্বর, তেমনি ডি. গুপ্ত ঔষধ। আগে লোকে যোগযাগ, তপস্যা করত; এখন কলির জীব অন্নগত প্রাণ, দুর্বল মন, এক হরিনামই একাগ্র হয়ে করলে সব সংসারব্যাধি নাশ পায়।

৩। জান্তে, অজান্তে বা ভ্রান্তে যে কোন ভাবেই হোক না কেন, তাঁর নাম করলেই ফল হবে। কেউ তেল মেখে নাইতে যায়, তারও যেমন স্নান হয়, আর যদি কাউকে জলে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়, তারও তেমনি স্নান হয় - আর কেউ ঘরে শুয়ে আছে, তার গায়ে জল ঢেলে দিলে তারও স্নানের কাজ হয়ে যায়।

৪। অমৃতকুণ্ডে যে কোন প্রকারে হোক, একবার পড়তে পারলেই অমর হওয়া যায়; কেউ যদি স্তবস্তুতি ক'রে পড়ে, সেও অমর হয়, আর কাউকে যদি কোন রকমে ঠেলে সেই অমৃতকুণ্ডে ফেলে দেওয়া যায়, সেও অমর হয়; তেমনি ভগবানের নাম জান্তে অজান্তে বা ভ্রান্তে যে প্রকারে হোক, নিলে তার ফল হবেই হবে।

৫। এই কলিযুগে নারদীয় ভক্তিমতই প্রশস্ত। অন্য অন্য যুগে নানা রকমের কঠোর সাধনের নিয়ম ছিল; সে সকল সাধনে এ যুগে সিদ্ধিলাভ করা বড় কঠিন। একে জীবের অল্প পরমায়ু, তাতে মালোয়ারী (ম্যালেরিয়া) রোগে কাবু ক'রে ফেলে, কঠোর তপস্যা কেমন ক'রে করবে?

ধর্মপ্রচার

১। সাধু-মহাপুরুষদিগকে নিকটস্থ আত্মীয় লোকেরা অগ্রাহ্য করে, দূরের লোকদিগের নিকট তাঁদের আদর হয়, এর কারণ কি? - যেমন বাজিকরের বাজি, তাদের কাছের আত্মীয় লোকেরা দেখে না, দূরের লোকেরা দেখে অবাক হয়ে যায়।

২। বজ্রবাঁটুলের বীচি গাছের তলায় পড়ে না, উড়ে গিয়ে দূরে পড়ে ও সেখানে গাছ হয়। সেই রকম ধর্মপ্রচারকদিগের ভাব দূরেতেই প্রকাশ হয় ও লোকে আদর করে।

৩। লণ্ঠনের নীচে অন্ধকার থাকে, দূরে আলো পড়ে। সেই রকম সাধু মহাপুরুষদের নিকটের লোকেরা বুঝতে পারে না, দূরের লোকেরা তাঁদের ভাবে মুগ্ধ হয়।

৪। আপনাকে মারতে হলে একটি নরুন দিয়ে হয়; কিন্তু অপরকে মারতে গেলে, ঢাল-তরবারের দরকার হয়। তেমনি লোকশিক্ষা দিতে হলে অনেক শাস্ত্র পড়তে হয় ও অনেক তর্ক-যুক্তি ক'রে বোঝাতে হয়, কিন্তু আপনার ধর্মলাভ কেবল একটি কথায় বিশ্বাস করলেই হয়।

৫। ও দেশেতে লোকে যখন ধান মাপে, একজন মাপতে থাকে আর একজন পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে; যেই কম পড়ে আসে, পেছনে যে গাদা করা থাকে, তা থেকে ঠেলে দিয়ে তার সামনে যুগিয়ে দেয়। তেমনি যারা ঠিক ঠিক সাধু ভক্ত, ঈশ্বরীয় কথা বলা ফুরাতে না ফুরাতে তাদের ভেতর থেকে ভাব যুগিয়ে আসে। তাদের ভাব আর ফুরোয় না।

৬। যেমন একজন কাঠ ইত্যাদি সংগ্রহ ক'রে আগুন জ্বেলে বসে থাকে, আর পাঁচজনেও এসে বসে পোহায়; তেমনি সাধু-সন্ন্যাসীরা কঠোর তপস্যা ক'রে ভগবানকে জানেন, আর পাঁচজন এসে তাঁদের সঙ্গ করে, তাঁদের উপদেশ শুনে ভগবানে চিত্ত স্থির করে।

৭। প্রকৃত প্রচার কি রকম জান? লোককে না ভজিয়ে আপনি ভজলে যথেষ্ট প্রচার হয়। যে আপনি মুক্ত হতে চেষ্টা করে, সে যথার্থ প্রচার করে। যে আপনি মুক্ত, শত শত লোক কোথা হতে আপনি এসে তার কাছে শিক্ষা লয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ঠাকুর বলতেন, "ফুল ফুটলে ভ্রমর আপনি এসে জোটে।"

বিবিধ

১। কলিকাতার কোন বিখ্যাত ধনী ঠাকুরকে দর্শন করতে এসে নানা প্রকার কূট তর্ক উত্থাপন করতে আরম্ভ করলেন। ঠাকুর তাঁকে বললেন, "বৃথা তর্কে লাভ কি? সরলতার সঙ্গে ভগবানকে ডেকে যাও, তা হলে তোমার নিজের কাজ হবে।" কথাগুলি সেই দাম্ভিক ব্যক্তির মনোমত না হওয়ায় তিনি বলে উঠলেন, "আপনি কি সব জানতে পেরেছেন?" ঠাকুর অতি বিনীতভাবে হাতজোড় ক'রে তাঁকে বললেন, "আমি কিছু জানতে পারিনি সত্য, কিন্তু ঝাঁটা নিজে অপবিত্র হলেও যে স্থান ঝাঁট দেয়, সে স্থানকে পবিত্র করে।"

২। বনে ভ্রমণ করতে করতে রাম পম্পা সরোবরে জল পান করতে নেমেছিলেন, ধারে তীরধনুক মাটিতে পুঁতে জলে নেমেছিলেন। উঠে এসে দেখেন ধনুকে বিদ্ধ হয়ে একটি ব্যাঙ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। রাম মহা দুঃখিত হয়ে তাকে বললেন, "তুমি শব্দ করলে না কেন? শব্দ করলে, আমরা জানতে পারতাম, তা হলে আর তোমার এদশা হতো না।" ব্যাঙটা বললে, "রাম, যখন বিপদে পড়ি, তখন 'রাম রক্ষা কর' বলে ডাকি; এখন রামই যখন মারছেন তখন আর কাকে ডাকব?"

৩। একটি সাধ্বী ভগবৎপরায়ণা স্ত্রীলোক সংসারে থেকে পতি-পুত্রের সেবা করতেন আর ভগবানের চিন্তা করতেন। একদিন রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর পতি প্রাণত্যাগ করেন। পতির সত্কারাদি শেষ ক'রে তিনি হাতের কাচের চুড়ি ভেঙ্গে ফেলে সোনার বালা পরলেন। সবাই জিজ্ঞাসা করায় বললেন, "আমার স্বামীর দেহ এতদিন এই কাচের চুড়ির মতো ক্ষণভঙ্গুর ছিল। তাঁর অনিত্য দেহ চলে গিয়েছে। এখন আর তিনি ক্ষণভঙ্গুর নন, তিনি নিত্য অখণ্ডস্বরূপ। তাই আমি কাচের চুড়ি ছেড়ে পাকা গয়না পরেছি।"

৪। গঙ্গাজল জলের মধ্যে নয়, শ্রীবৃন্দাবনের রজঃ ধুলোর মধ্যে নয়, আর শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ অন্নের মধ্যে নয়। এই তিন ব্রহ্মের স্বরূপ।