১। যেমন জালার ভেতর কোনখানে একটি ছোট ছিদ্র থাকলে ক্রমে ক্রমে সব জল বেরিয়ে যায়, তেমনি সাধকের ভেতরেও একটু সংসারাসক্তি থাকলে সব সাধনা বিফল হয়ে থাকে।
২। কাঁচা মাটিতে গড়ন হয়, পোড়া মাটিতে আর গড়ন চলে না। যার হৃদয় একেবারে বিষয়বুদ্ধিতে পুড়ে গেছে, তাতে আর পারমার্থিক ভাব ধরে না।
৩। চিনিতে বালিতে মিশে থাকলে পিঁপড়ে যেমন বালি ফেলে চিনি খায়, তেমনি সাধু ও পরমহংসেরা এ সংসারে সদ্বস্তু যে সচ্চিদানন্দ তাঁকেই গ্রহণ করে, আর অসদ্বস্তু যে কাম-কাঞ্চন, সে সমস্ত ত্যাগ করে।
৪। কাগজে তেল লাগলে তাতে আর লেখা চলে না, তেমনি জীবে কাম-কাঞ্চনরূপ তেল লাগলে তাতে আর সাধন চলে না। সে তেলমাখা কাগজ খড়ি দিয়ে ঘষে নিলে তাতে লেখা যায়, তেমনি জীবে কাম-কাঞ্চনরূপ তেল লাগলে ত্যাগরূপ খড়ি দিয়ে ঘষে নিলে তবে সাধন চলে।
৫। যে সকল লোক নিজে কখন ধর্মচর্চা করে না, অন্যকেও ধ্যান [কি] পূজা করতে দেখলে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, ধর্ম ও ধার্মিকদের নিন্দা করে, সাধন-অবস্থায় কখনও এরূপ লোকদের সঙ্গ করবে না। তাদের কাছ থেকে একেবারে দূরে থাকবে।
৬। গরুর পালে যদি অন্য কোন জন্তু এসে ঢোকে তা হলে সব গরুগুলো তাকে গুঁতিয়ে তাড়িয়ে দেয়, কিন্তু গরু এলে তার সঙ্গে গা চাটাচাটি করে। সেই রকম যখন ভক্তের সঙ্গে ভক্তের দেখা হয় তখন তারা উভয়ে ধর্মকথা কয়, বড় আনন্দ করে আর হঠাৎ সে সঙ্গ ত্যাগ করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বিজাতীয় লোক এলে তার সঙ্গে মেশামেশি করে না।
৭। যে পুকুরে অল্প জল, তার যেমন জল পান করতে গেলে ওপর থেকে আস্তে আস্তে নেড়ে জল খেতে হয়, বেশী নাড়তে নেই, নাড়লে তার ভেতর হতে ময়লা উঠে জল ঘোলা হয়ে যায়, তেমনি যদি সচ্চিদানন্দলাভ করতে চাও তা হলে তুমি গুরুবাক্যে বিশ্বাস ক'রে ধীরে ধীরে সাধন কর। মিছে কেবল শাস্ত্রবিচার [আর] তর্ক করো না, ক্ষুদ্র মন অল্পতেই গুলিয়ে যায়।
৮। ভূত ছাড়বে কেমন ক'রে বল? যে সরষে দিয়ে ভূত ছাড়াবে তারই মধ্যে ভূত ঢুকে বসে আছে; যে মন দিয়ে সাধন-ভজন করবে তাই যদি বিষয়াসক্ত হয়ে পড়ে, তা হলে সাধন-ভজন কি ক'রে হবে?
৯। মন-মুখ এক করাই হচ্ছে প্রকৃত সাধন। নতুবা মুখে বলছি, 'হে ভগবান্! তুমি আমার সর্বস্ব ধন' এবং মনে বিষয়কেই সর্বস্ব জেনে বসে রয়েছি - এইরূপ লোকের সকল সাধনাই বিফল হয়।
১০। বাসনার লেশমাত্র থাকতে ভগবানলাভ হয় না। যেমন সূতোতে একটু ফেঁসো বেরিয়ে থাকতে ছুঁচের ভেতর যায় না। মন যখন বাসনারহিত হয়ে শুদ্ধ হয়, তখনই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়।
১১। যারা ঈশ্বরলাভের জন্য সাধন-ভজন করতে চায় তারা যেন কোন রকমে কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত না হয়ে পড়ে, কামিনী-কাঞ্চনের সংস্রব থাকলে কোন কালেও তাদের সিদ্ধাবস্থালাভের উপায় নেই। যেমন খই ভাজবার সময় যে খইটি খোলার উপর থেকে ঠিকরে বাইরে পড়ে, তাতে কোন দাগ লাগে না, কিন্তু গরম বালির খোলায় থাকলে কোন কোন স্থানে কাল দাগ লাগে।
১২। বিষয়, ছেলে, কিংবা মান-সম্ভ্রমের জন্য কেহ যেন কামনা ক'রে ঈশ্বরের সাধনা না করে, যে শুধু সচ্চিদানন্দ-লাভের জন্য তাঁর নিকট প্রার্থনা করে, তার নিশ্চয়ই ঈশ্বর-লাভ হয়।
১৩। যেমন বাতাসে জল নড়লে ঠিক প্রতিবিম্ব দেখা যায় না, তেমনি মন স্থির না হলে তাতে ভগবানের প্রকাশ হয় না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মন চঞ্চল হয়। এইজন্য যোগীরা আগে কুম্ভক দ্বারা মন স্থির ক'রে ভগবানের ধ্যান-ধারণা করেন।
১৪। ভাবের ঘরে যার চুরি না থাকে, তারই সচ্চিদানন্দ লাভ হয়। অর্থাৎ কেবল সরলভাবে ও বিশ্বাসেই তাঁকে পাওয়া যায়।
১৫। যেমন সাপ দেখলে লোকে বলে থাকে, "মা মনসা, মুখটি লুকিয়ে রেখো, আর ল্যাজটি দেখিয়ো", তেমনি যুবতী স্ত্রীলোক দেখলে মা বলে নমস্কার করা উচিত ও তাদের মুখের দিকে না চেয়ে পায়ের দিকে চাইবে। তা হলে আর প্রলোভনের আর পতনের আশঙ্কা থাকবে না।
১৬। বিদ্যাশক্তিই হউক বা অবিদ্যাশক্তিই হউক, সাধু-সন্ন্যাসী ও ভক্তমাত্রেই সব স্ত্রীলোককে মা আনন্দময়ীর রূপ বলে জানবে।
১৭। খুব জনশূন্য স্থানে যুবতী স্ত্রীলোককে দেখে যে মা বলে চলে যেতে পারে, তাকেই ঠিক ঠিক ত্যাগী বলা যায়, আর, যে লোক সভার মাঝখানে ত্যাগী সেজে থাকে, তাকে প্রকৃত ত্যাগী বলা যায় না।
১৮। অভিমানের জড় মরেও মরে না, যেমন ছাগলটাকে কেটে ফেলে তার ধড় মুণ্ডু হতে পৃথক্ করলেও কিছুক্ষণ ধরে নড়তে থাকে।
১৯। অভিমানশূন্য হওয়া বড় কঠিন। প্যাঁজ রসুনকে ছেঁচে কোন পাত্রে রেখে, তার পর পাত্রটিকে শতবার ধুয়ে ফেললেও তার গন্ধ যেমন কিছুতেই যায় না, সেই প্রকার অভিমানের লেশ কিছু না কিছু থেকে যায়।
২০। ঠিক ঠিক সন্ন্যাসী বা ত্যাগীর লক্ষণ কিরূপ জান? তারা কামিনী-কাঞ্চনের কোনরূপ সংস্পর্শে থাকবে না। এমন কি, স্বপ্নেও যদি কামিনী-সহবাস হচ্ছে বলে জ্ঞান হয় এবং তদ্দ্বারা রেতঃস্খলন হয়, কিংবা অর্থের ওপর আসক্তি জন্মায়, তা হলে এত দিনের সাধন-ভজন সব নষ্ট হয়ে যায়।
২১। ভগবান্ কল্পতরু। কল্পতরুর নিকট বসে যে যা-কিছু প্রার্থনা করে, তাই তার লাভ হয়। এই নিমিত্ত সাধন-ভজনের দ্বারা যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন খুব সাবধানে কামনা ত্যাগ করতে হয়। কেমন জান? -
এক ব্যক্তি কোন সময় ভ্রমণ করতে করতে অতি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হয়। পথে রৌদ্রের তাপে এবং পথভ্রমণের ক্লেশে অতিশয় ক্লান্ত ও ঘর্মাক্তকলেবর হয়ে কোন একটি বৃক্ষের নিম্নে উপবেশন ক'রে শ্রান্তি দূর করতে করতে মনে মনে ভাবলে যে, এই সময়ে যদি একটি উত্তম শয্যা মেলে, তা হলে তাতে অতি সুখে নিদ্রা যাই। পথিক যে কল্পতরুর নিম্নে বসে ছিল, তা সে জানত না। মনে মনে যেমন এই বাসনা উঠল তৎক্ষণাৎ সেইখানে উত্তম শয্যা এসে পড়ল। পথিক অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে তাহাতেই শয়ন করলে ও মনে মনে ভাবতে লাগল, এই সময় যদি একটি স্ত্রীলোক এসে আমার পদসেবা করে, তা হলে অতি সুখে শয়ন করতে পারি। এই সঙ্কল্প হতে না হতেই তখনই এক যুবতী পথিকের পদতলে এসে উপবেশনপূর্বক তার সেবা করতে লাগল। পথিকের এই দেখে আহ্লাদের আর সীমা রইল না। তারপর তার খুব ক্ষুধা পেতে লাগল ও সে মনে করলে যা ইচ্ছা করেছিলুম তা পেলুম, তবে কি খাবার কিছু জিনিস পাব না? বলতে না বলতে তার নিকট অমনি নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য এসে জুটল। পথিক সেগুলি দিয়ে তখনই উদর পূর্ণ ক'রে সেই শয্যায় শয়নপূর্বক সেদিনকার সব ঘটনা ভাবছে; এমন সময় তার মনে হল যে এ সময় যদি হঠাৎ একটা বাঘ এসে পড়ে, তাহলেই বা কি করা যায়। যেমন এইটি মনে হওয়া অমনি এক প্রকাণ্ড বাঘ লাফ দিয়ে এসে তাকে ধরলে এবং তার ঘাড় থেকে রক্ত পান করতে লাগল। অবশেষে পথিকের জীবন শেষ হল। এই সংসারে জীবেরও ঠিক এইরূপ দশা ঘটে থাকে। ঈশ্বরসাধন করতে গিয়ে বিষয়, ধন, জন অথবা মান, যশ ইত্যাদির কামনা করলে তা কিছু কিছু লাভ হয় বটে কিন্তু শেষে ব্যাঘ্রেরও ভয় থাকে। অর্থাৎ রোগ, শোক, তাপ, মান, অপমান ও বিষয়নাশরূপ ব্যাঘ্র স্বাভাবিক ব্যাঘ্র হতেও লক্ষগুণে যন্ত্রণাদায়ক।
২২। এক ব্যক্তির মনে হঠাৎ বৈরাগ্যভাব উদয় হতে আত্মীয় ভাইদের নিকট বলল, "সংসার আমার ভাল লাগছে না। এখনি আমি কোন নির্জন স্থানে গিয়ে ঈশ্বর-আরাধনা করব।" তার আত্মীয়েরা এই শুভ সঙ্কল্পে সম্মতি দিল। উক্ত ব্যক্তি বাড়ি হতে বাহির হয়ে ক্রমে এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হয়ে ঘোরতর তপস্যা করতে আরম্ভ করলে। ক্রমান্বয়ে বার বৎসর কাল তপস্যা ক'রে ও কিছু কিছু সিদ্ধাই লাভ ক'রে পুনরায় বাড়িতে ফিরল। তার আত্মীয়-স্বজনেরা অনেকদিন পরে তাকে দেখে সকলেই আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল ও কথাবার্তা-প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, "এতদিন তপস্যা ক'রে কি জ্ঞানলাভ করলে?" তখন সেই ব্যক্তি ঈষৎ হাস্য ক'রে সম্মুখে একটি হাতী চলে যাচ্ছে দেখে, হাতীর নিকট গিয়ে তার গা তিনবার স্পর্শ ক'রে যেমন বললে, 'হাতী তুই মরে যা', অমনি হাতীটা তার স্পর্শে মৃতবৎ হয়ে গেল; কিছুক্ষণ পরে আবার গায়ে হাত দিয়ে যেমন বললে, 'হাতী বাঁচ্' অমনি হাতী বেঁচে উঠল।
তারপর বাড়ির সম্মুখে নদীর ধারে গিয়ে মন্ত্রবলে এপার হতে পরপারে চলে গেল, আবার ঐভাবে নদী পার হয়ে এল। তার ভাইয়েরা এই সব দেখে খুব আশ্চর্য হল বটে, কিন্তু তপস্বী-ভাইকে বলতে লাগল - "ভাই, এতদিন কেবল বৃথা তপস্যা করেছ; হাতী মরল ও বাঁচল তাতে তোমার কি লাভ হল? আর তুমি বার বছর ধরে কঠোর তপস্যা ক'রে নদী পারাপার করতে শিখেছ; আমরা এক পয়সা খরচ করে থাকি। অতএব তুমি কেবল বৃথা সময় নষ্ট করেছ।" ভাইদের নিকট এইরূপ শ্লেষপূর্ণ কথা শুনে তার যথার্থই হুঁশ হল ও সে বলতে লাগল, "যথার্থই আমার নিজের কি হল?" এই বলে তৎক্ষণাৎ ভগবানের দর্শনলাভের জন্য পুনরায় ঘোরতর তপস্যা করতে চলে গেল।
২৩। নিজেকে বেশী চতুর মনে করা উচিত নয় - যেমন কাক খুব চতুর, কিন্তু বিষ্ঠা খেয়ে মরে, তেমনি সংসারক্ষেত্রে যারা বেশী চালাকি করতে যায়, তারাই কেবল ঠকে থাকে।
২৪। একদিন গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে এক হাতে একটা টাকা নিয়ে আর এক হাতে মাটি নিয়ে 'মাটিই টাকা, টাকাই মাটি', এইরূপ বিচার ক'রে উভয়কে যখন গঙ্গার জলে ফেলে দিলুম, তখন মনে একটু ভয় ও ভাবনা এল। ভাবলুম - মা লক্ষ্মী যদি রাগ করেন ও তিনি যদি খেতে না দেন। তার পরে মনে বললুম, "মা লক্ষ্মী, তুমিই আমার হৃদয়ে থাক, তোমার ঐশ্বর্য আমি চাই না।"
২৫। ঈশ্বর দুবার হাসেন। যখন ভায়ে ভায়ে দড়ি ধরে জমি বখরা করে নেয় আর বলে, "এ দিকটা আমার, ও ঐ দিকটা তোমার", তখন একবার হাসেন। আর একবার হাসেন যখন লোকের অসুখ কঠিন হয়ে পড়েছে, আত্মীয়স্বজনেরা সকলে কান্নাকাটি কচ্ছে, বৈদ্য এসে বলছে, "ভয় কি? আমি ভাল করে দেব।" বৈদ্য জানে না যে, ঈশ্বর যদি মারেন, তবে কার সাধ্য তাকে রক্ষা করে।
২৬। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, "হে অর্জুন, অষ্ট সিদ্ধির মধ্যে একটি সিদ্ধিও থাকলে পরে আমার যে সেই পরম ভাব, তা তুমি লাভ করতে পারবে না।" অতএব যারা ঠিক ঠিক ভক্ত ও জ্ঞানী, তারা যেন কোনরূপ সিদ্ধি কামনা না করে।
২৭। লক্ষ্মীনারায়ণ নামক একজন মাড়োয়ারী সৎসঙ্গী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুরকে দর্শন করতে আসেন। ঠাকুরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বেদান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। ঠাকুরের সহিত ধর্মপ্রসঙ্গ ক'রে ও তাঁর বেদান্ত সম্বন্ধে আলোচনা শুনে তিনি বড়ই প্রীত হন। পরিশেষে ঠাকুরের নিকট হতে বিদায় নেবার সময় বলেন, "আমি দশ হাজার টাকা আপনার সেবার নিমিত্ত দিতে চাই।" ঠাকুর এই কথা শোনবামাত্র, মাথায় দারুণ আঘাত লাগলে যেরূপ হয়, মূর্ছাগতপ্রায় হলেন। কিছুক্ষণ পরে মহাবিরক্তি প্রকাশ ক'রে বালকের ন্যায় তাকে সম্বোধন ক'রে বললেন, "শালা, তুম্ হিঁয়াসে আভি উঠ্ যাও। তুম্ হামকো মায়াকা প্রলোভন দেখাতা হ্যায়।" উক্ত মাড়োয়ারী ভক্ত একটু অপ্রতিভ হয়ে ঠাকুরকে বললেন, "আপ্ আভি থোড়া কাঁচা হ্যায়।" ইহার উত্তরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, "ক্যায়সা হ্যায়।" মাড়োয়ারী ভক্ত বললেন, "মহাপুরুষ লোগোকোঁ খুব উচ্চ অবস্থা হোনেসে ত্যাজ্য গ্রাহ্য এক সমান বরাবর হো যাতা হ্যায়, কোই কুছ্ দিয়া অথবা লিয়া উসমে উনকা চিত্তমে সন্তোষ বা ক্ষোভ কুছ্ নেহি হোতা।" ঠাকুর ঐ কথা শুনে ঈষৎ হেসে তাকে বুঝাতে লাগলেন, "দেখ, আর্শিতে কিছু অপরিষ্কার দাগ থাকলে যেমন ঠিক ঠিক মুখ দেখা যায় না, তেমনি যার মন নির্মল হয়েছে, সেই নির্মল মনে কামিনী-কাঞ্চন-দাগ পড়া ঠিক নয়।" ভক্ত মাড়োয়ারী বললেন, "বেশ কথা, তবে হৃদয়, যে আপনার সেবা করে, না হয় তার নামে আপনার সেবার জন্য টাকা থাক।" তদুত্তরে ঠাকুর বললেন, "না, তাও হবে না। কারণ, তার নিকট থাকলে যদি কোন সময় আমি বলি যে অমুককে কিছু দাও বা অন্য কোন বিষয়ে আমার খরচ করতে ইচ্ছা হয়, তাতে যদি সে দিতে না চায় তার মনে সহজেই এই অভিমান আসতে পারে যে, ও টাকা তো তোর নয়, ও আমার জন্য দিয়েছে। এও ভাল নয়।" মাড়োয়ারী ভক্ত ঠাকুরের এই কথা শুনে আশ্চর্য হলেন এবং ঠাকুরের এই অদৃষ্টপূর্ব ত্যাগভাব দেখে নিরতিশয় প্রীত হয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন।
২৮। টাকার অহঙ্কার করতে নেই। যদি বল আমি ধনী, ধনীর আবার তারে বাড়া তারে বাড়া আছে। সন্ধ্যার পর যখন জোনাকী পোকা ওঠে, সে মনে করে, আমি এই জগৎকে আলো দিচ্ছি; কিন্তু যেই নক্ষত্র উঠল, অমনি তার অভিমান চলে গেল। তখন নক্ষত্রেরা মনে করে, আমরা জগৎকে আলো দিচ্ছি; কিন্তু পরে যখন চন্দ্র উঠল, তখন নক্ষত্রেরা লজ্জায় মলিন হয়ে গেল। চন্দ্র মনে করলে, আমার আলোয় জগৎ হাসছে। দেখতে দেখতে অরুণোদয় হল, তখন চন্দ্র মলিন হয়ে গেল। খানিক পরে আর দেখা গেল না। ধনীরা যদি এগুলি ভাবে, তাহলে আর তাদের ধনের অহঙ্কার থাকে না।
২৯। "এক কৌপীন কা ওয়াস্তে।" একজন সাধু গুরূপদেশ নিয়ে ভগবানের সাধন-ভজন করবার উদ্দেশ্যে কোন গ্রামের কাছে একটি নির্জন প্রান্তরের মধ্যে সামান্য একটি পর্ণকুটীর ক'রে তার মধ্যে বাস করতে লাগলেন ও সাধন-ভজন করতে লাগলেন। তিনি প্রত্যহ প্রত্যূষে উঠে স্নান ইত্যাদি ক'রে তাঁর ভিজে কাপড় ও কৌপীন কুটীরের কাছে একটি গাছে শুকোবার জন্য রেখে দিতেন। সাধু যখন ভিক্ষার জন্য বেরিয়ে যেতেন, সেই সময় ইঁদুর এসে তাঁর সেই কৌপীন কেটে দিত। সাধু পরদিন গ্রামে গিয়ে আবার নূতন কৌপীন ভিক্ষা ক'রে আনতেন। অল্পদিন পরে সাধু স্নানান্তে আবার ঐ ভিজে কৌপীন কুটীরের ওপর শুকোবার জন্য রেখে দিলেন এবং ভিক্ষান্নের জন্য গ্রামে গেলেন। ভিক্ষান্তে কুটীরে ফিরে এসে দেখলেন, ইঁদুর আবার তাঁর কৌপীন টুকরো টুকরো ক'রে কেটে ফেলেছে। তিনি তাই দেখে মনে মনে বড় বিরক্ত হলেন এবং ভাবতে লাগলেন, "আবার কোথায় কার কাছে কৌপীন ভিক্ষা করব?" পরদিন আবার ভিক্ষায় বেরিয়ে গ্রামবাসীদের কাছে ইঁদুরের উপদ্রবের কথা জানালেন। গ্রামবাসীরা সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বল্লে, "আপনাকে রোজ রোজ কে কৌপীন দেবে? আপনি এক কাজ করুন - একটা বেড়াল পুষুন, তাহলে আর বেড়ালের ভয়ে ইঁদুর আসবে না।" সাধু তৎক্ষণাৎ গ্রাম থেকে একটা বেড়ালের বাচ্চা নিয়ে এলেন। সেই দিন থেকেই বেড়ালের ভয়ে ইঁদুরের উপদ্রব বন্ধ হল। তা দেখে সাধুর আনন্দের সীমা রইল না। ক্রমে সাধু সেই বেড়ালটাকে বেশ আদর-যত্নে লালন-পালন করতে লাগলেন এবং গ্রামে গিয়ে বেড়ালের জন্য দুধ ভিক্ষা ক'রে এনে খাওয়াতে লাগলেন। কিছুদিন পর কোন ব্যক্তি তাঁকে বললে, "সাধুজী, আপনার রোজ দুধের দরকার; দু-চার দিন ভিক্ষা ক'রে চলতে পারে। বার মাস কে আপনাকে দুধ দেবে? আপনি এক কাজ করুন, একটি গরু পুষুন, তা হলে তার দুধ খেয়ে আপনি নিজেও পরিতৃপ্ত হবেন, বেড়ালকেও খাওয়াতে পারবেন।" অল্পদিনের মধ্যেই সাধু একটি দুগ্ধবতী গাভী সংগ্রহ ক'রে নিয়ে এলেন, সাধুকে আর দুধের জন্য ভিক্ষা করতে হল না।
ক্রমে সাধু সেই গরুর খড়-বিচিলী ইত্যাদির জন্য গ্রামে ভিক্ষা করতে লাগলেন। তখন গ্রামের লোকেরা তাঁকে বলতে লাগল, "আপনার কুটীরের নিকট পতিত জমিতে চাষ বাস করুন, তা হলে আর খড়-বিচিলীর জন্য ভিক্ষা করতে হবে না।" তখন সাধু সকলের পরামর্শে নিকটস্থ পতিত জমিতে চাষ আরম্ভ করলেন। চাষের জন্য তাঁকে ক্রমে লোক ইত্যাদি নিযুক্ত করতে হল। যখন শস্যাদি সঞ্চিত হতে লাগল, তা রাখবার জন্য গোলাবাড়ি ইত্যাদি প্রস্তুত ক'রে তিনি ঠিক গৃহস্থের মতো মহাব্যস্ত হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। কিছুদিন পরে সাধুটির গুরু এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি ঐ সকল বিষয়-বৈভব দেখে একটি চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, "এইখানে একটি ত্যাগী কুটীরমধ্যে থাকতেন, তিনি কোথায় গেছেন বলতে পার?" চাকরটি কোন উত্তর দিতে পারলে না। পরে তিনিই ঐ সাধুর বাড়ির মধ্যে ঢুকে সামনে তাঁর শিষ্যকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "বৎস, এসব কি?" শিষ্য অপ্রতিভ হয়ে অমনি গুরুর পায়ে পড়ল এবং বলতে লাগল, "প্রভুজী, এসব এক কৌপীনকা ওয়াস্তে।" সাধুটি একে একে সব বৃত্তান্ত গুরুর নিকট বলতে লাগলেন। গুরুর দর্শনে তাঁর সকল আসক্তি কেটে গেল ও তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সব বিষয়-সম্পত্তি পরিত্যাগ ক'রে গুরুর পশ্চাদ্গামী হলেন।
৩০। হৃদয় মুখুজ্যে একদিন ঠাকুরকে বলেছিলেন, "মামা, তোমার প্রতি মার যখন এত দয়া, তুমি মার কাছ থেকে কিছু সিদ্ধাই চেয়ে নাও না কেন?" ঠাকুরের তখন বালকের ন্যায় অবস্থা। হৃদুর এই কথা শুনে তিনি একদিন চাঁপাতলার পুষ্করিণীর ঘাটে বসে বালকের ন্যায় মাকে বলতে লাগলেন, "মা হৃদু বলে, তুমি মার কাছ থেকে সিদ্ধাই চেয়ে নাও না কেন?" এই বলে তিনি মাকে চিন্তা করতে লাগলেন। অল্পক্ষণ পরেই তিনি সম্মুখে দেখলেন, একটি কালপেড়ে কাপড় পরা মোটা স্ত্রীলোক শৌচে বসেছে। তার পরক্ষণেই চলে এসে হৃদয়কে বললেন, "শ্যালা, তুই আমাকে কি বুদ্ধি দিয়েছিস্? আমি আর তোর কোন বুদ্ধিই নেব না। তোর কথা শুনে মাকে যেমন বললুম, 'মা, হৃদু আমাকে বলে, তুমি মার কাছ থেকে সিদ্ধাই চেয়ে নাও না কেন?' মা তৎক্ষণাৎ আমাকে ঐরূপ দেখিয়ে দিলেন।"